প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর দেশের সংসদ নির্বাচনি ট্রেন যখন চলতে শুরু করেছে, তখন তার গন্তব্য নিয়ে শঙ্কা-সংশয় বাড়ছে রাজনীতির মাঠে। গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগেই যখন নির্বাচনের ঘোষণা দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনুস, এরপর নিজেদের দাবি দাওয়া তুলে ধরতে শুরু করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি। যদিও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান বার্ষিকীতে প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এমন বাস্তবতায় গতকাল বৃহস্পতিবার ইসি সচিব আখতার আহমেদ আশা প্রকাশ করেন, আগামী সপ্তাহে জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে। এর পরও জুলাই সনদ ও পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াত, এনসিপিসহ দেশি-বিদেশি চাপে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের একাংশ। যদিও বিএনপি মনে করে, অপর দুটি দলের বর্তমান অবস্থান রাজনৈতিক স্টান্টবাজি, ঘোষিত সময়েই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এরই মধ্যে মালয়েশিয়া সফরে গিয়ে প্রধান উপদেষ্টা আবারও জানিয়েছেন, ‘নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে আমরা প্রস্তুত, নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করে দিয়েছি।’ একই দিন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না।’ শর্ত দিয়ে বলেছেন ‘সংস্কার ও নতুন সংবিধান ছাড়া এই নির্বাচন হলে অন্তর্বর্তী সরকারকে গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ হওয়া ব্যক্তিদের মায়েদের বুকে তাদের সন্তানদের ফেরত দিতে হবে।’
একই অনুষ্ঠানে এনসিপির প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামতে দেওয়া হবে না, যদি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিতে চায়।’
তিনি আল্টিমেটাম দিয়ে বলেছেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্রে ছাড় দেওয়া হলেও জুলাই সনদে ছাড় দেওয়া হবে না এক চুলও।’ আর জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলছেন, পিআর পদ্ধতি ছাড়া নির্বাচনে যাবেন না তারা। প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলনে নামবেন। এ অবস্থায় রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন- এত শর্তের বেড়াজাল ছিঁড়ে সরকার কি পারবে নির্বাচন করতে?
নির্বাচন নিয়ে যখন সন্দেহ-সংশয় বাড়ছে, তখন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ গত বুধবার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘কোনো ব্যক্তি বা দলের কথায় নির্বাচন বন্ধ হবে না। আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুন্দর করার লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় সব ধরনের সহায়তা করছে। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সব ধরনের লজিস্টিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আগামী নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধে অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নেবে। তবে সেটা নির্ভর করবে রাজনীতিবিদদের ওপর।’
এরই মধ্যে আগামী সপ্তাহে সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হবে বলে গতকাল বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ।
এমন বাস্তবতায় ভোটের মাঠে বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী হবে কে? যেহেতু আওয়ামী লীগ (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) মাঠে না থাকায় নির্বাচনে জামায়াতই হবে বিএনপির প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে এ দুই দলের মধ্যে নির্বাচনি সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। এরই মধ্যে রাজনীতির মাঠে তাদের অবস্থান স্পষ্ট। ইতিমধ্যে ৩০০ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে জামায়াত। তারা প্রচারও চালাচ্ছে সমানভাবে। সারা দেশেই তাদের প্রার্থীরা প্রতীকসহ লাগিয়েছেন পোস্টার, ফেস্টুন।
বনশ্রী-রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতের পক্ষে মিছিল করতেও দেখা গেছে। তবে অন্যান্য ইসলামী দলের সঙ্গে জামায়াত নির্বাচনিী সমঝোতা বা আসন ভাগাভাগি করতে পারে বলে জানা গেছে। এনসিপি সেই সমঝোতায় নিজেকে যুক্ত করবে, নাকি এককভাবে ভোট করবে, তা পরিষ্কার নয় এখনো। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, অতি আত্মবিশ্বাসী এনসিপির নেতারা কিছুদিন আগেও বলতেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তারা সরকার গঠন করবেন অথবা প্রধান বিরোধী দল হবেন।
সম্প্রতি ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ‘পালস সার্ভে ৩’-এর ফলাফলে দেখা যায়, ৪৮ দশমিক ৫০ শতাংশ মানুষ বলছেন, কাকে ভোট দেবেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্তই নেননি। গত বছরের অক্টোবরে ৩৮ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন, তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি। কাকে ভোট দেবেন, তা বলতে চান না ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ মানুষ। আর ভোট দেবেন না বলেছেন ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। নির্বাচনের দিন-তারিখ কাছাকাছি ভোটারের মনস্থির করার কথা। তাহলে ভোটারদের মধ্যেও কি নির্বাচনের বিষয়ে সংশয় রয়ে গেছে- এমন প্রশ্ন রেখেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
সেই জরিপে দেখা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাকে ভোট দেবেনÑ এমন প্রশ্নে ১২ শতাংশ বিএনপি, ১০ দশমিক ৪০ শতাংশ জামায়াতে ইসলামী এবং ২ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষ জাতীয় নাগরিক পার্টির কথা বলেছেন। আট মাস আগে গত অক্টোবরে একই প্রশ্ন করা হলে ১৬ দশমিক ৩০ শতাংশ মানুষ বিএনপি, ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ জামায়াত ও ২ শতাংশ মানুষ এনসিপিকে ভোট দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ, আট মাস পর বিএনপি ও জামায়াতের ভোট কিছুটা কমেছে আর এনসিপির ভোট বেড়েছে সামান্যই। জরিপে গত অক্টোবরে ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ) ভোট দেওয়ার কথা বলেছিলেন, সেটি এখন কমে হয়েছে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজান মাস শুরুর আগেই নির্বাচন আয়োজনে সব ধরনের তোড়জোড় শুরু হলেও নির্বাচন ঘিরে এখনো সংশয় কাটেনি বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না সংকটের কোনো পরিস্থিতি তৈরি হবে। কিন্তু নির্বাচনকালে ল অ্যান্ড অর্ডারের ইস্যুটা নিয়ে সংশয় আছে।’ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকার কীভাবে ট্যাকল দেবে, সেটি বড় চ্যালেঞ্জ।
নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশের পাশাপাশি প্রায় সব দলের নেতারাই আরেকটি ১/১১-এর আশঙ্কা করছেন এবং এর জন্য একে অপরকে দায়ী করছেন। আরেকটি ১/১১ মানে আরেকটি ষড়যন্ত্র। আরেকটি ষড়যন্ত্র মানে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার পুনরাবির্ভাব বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করছে জাতীয় পার্টি। অভ্যুত্থানের এক বছর পর তাদের কৃতকর্মের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে চাইছে না তো?
কারও কারও মতে, আগামী নির্বাচনে তুরুপের তাস হতে পারে জাতীয় পার্টি। তাদের এমন আচরণকে বাঁকা চোখে দেখছে রাজনৈতিক দলগুলো। ফ্যাসিবাদের দোষর হিসেবে পরিচিতি পেলেও জাতীয় পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেপ্তার না হওয়ায় উল্টো দলটির একাংশের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের বিরুদ্ধে করা একটি মামলা প্রত্যাহার হওয়ার এমন সম্ভবনাও দেখছে কেউ কেউ।
নির্বাচন ইস্যুতে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে আসন্ন নির্বাচন দেশের মনুষের কাছে অধিক গ্রহণযেগ্য এবং সময়োপযোগী হবে। গণতন্ত্রের মূল বিষয় অধিকাংশ জনগণের মতকে প্রাধান্য দেওয়া। সুতরাং, পিআর পদ্ধতির বিরোধিতার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচন হয়েছে, সেই বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হলে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম হওয়ার সম্ভবনা থেকে যায়। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের যে সময় যোষণা করা হয়েছে, তা ইতিবাচক। তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে। এই সরকারের অধীনে ‘জুলাই সনদের’ আইনি ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে তার আলোকে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা উচিত।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি, তাতে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন করার পরিস্থিতি তৈরি হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান সংবিধান থেকে বাতিল, সংস্কার ও বিচারের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে সরকার এখন শুধু নির্বাচনকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। ফলে কিছু সমস্যা দৃশ্যমান হচ্ছে। তিনি বলেন, জুলাই সনদের ভিত্তিতে আগামী নির্বাচন দিতে হবে।
এদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আগামী নির্বাচন বয়কটকারীরা জাতীয় রাজনীতি থেকে মাইনাস হয়ে যাবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যেসব রাজনৈতিক দল বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদের তা পরিহারের আহ্বান জানান তিনি। জামায়াত-এনসিপির বক্তব্যকে তাদের রাজনৈতিক স্টান্ট হিসেবেই দেখছে বিএনপি।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো শঙ্কা দেখছে না বিএনপি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন বানচাল করতে পতিত শ্বৈরচার ষড়যন্ত্র করছে। সেই ফাঁদে পা না দিতে গণতান্ত্রকামী শক্তিগুলোর প্রতি আহ্বান তার।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন