কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের বালুকাভূমিতে জন্ম নিয়েছে সাগরলতা। সারি সারি সাগরলতা সৈকতের বালিয়াড়িতে ছড়িয়ে গেছে। এক কথায় সৈকতের বালিয়াড়ি দখলে নিয়েছে সবুজ কার্পেটের আদলে সাগরলতা। ঢেউয়ের ধারে ধীরে ধীরে জন্ম নেওয়া এই সবুজ বিছানা শুধু চোখে আনন্দই দেয় না, প্রকৃতির জন্য এক অসাধারণ উপহার। একসময় কুয়াকাটা সৈকতের চারদিকে এই সাগরলতা সবার চোখে পড়ত। পর্যটক বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির সৌন্দর্যের সবুজ কার্পেট সাগরলতা হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন সৈকতের সব জায়গায় সাগরলতা দেখা যায় না। তবে সৈকতের পূর্ব দিকে গঙ্গামতি এলাকার নির্দিষ্ট অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত এই উদ্ভিদ দেখা যাচ্ছে। দ্রুত রক্ষার উদ্যোগ না নিলে উপকূলের বালু ধরে রাখার ‘প্রাকৃতিক প্রহরী’ চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদেরা।
সাগরলতাকে স্থানীয়রা কেউ কেউ ‘গোস্তলতা’ আবার কেউ ‘ডাউঙ্গালতা’ কিংবা ‘গঙ্গালতা’ নামে চেনে। সাগরলতার বৈজ্ঞানিক নাম ‘ইপোমোয়া পেস-ক্যাপ্রিয়া’। এটি ‘কনভলভুলাসি’ গোত্রের উদ্ভিদ। সাগরলতা অতি খরাসহনশীল একটি উদ্ভিদ।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সৈকতের পূর্ব দিকে গঙ্গামতি, চরগঙ্গামতি, কাউয়ারচর এবং পশ্চিম দিকে লেম্বুরবর ও তিন নদীর মোহনা এলাকার বেলাভূমির কোথাও কোথাও ফুটেছে সাগরলতার ফুল। বালিয়াড়ির গহিনে ছড়িয়ে গেছে এর শেকড়। বালুর বুকে ঘটেছে সবুজের বিপ্লব। সাগরলতা বেড়ে ওঠে তপ্ত শুকনো বালুতে। দীর্ঘ ১৮ কিলোমিটার সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে জন্ম নিয়েছে ‘রেলরোড ভাইন’ নামের এই চমৎকার উদ্ভিদ। তবে সৈকতের জিরো পয়েন্ট এলাকায় চোখে পড়ে না এমন মনজুড়ানো দৃশ্য। কুয়াকাটায় আসা ভ্রমণপিপাসুদের আনাগোনার পদভারে হারিয়ে যায় এসব লতা। যেখানে পর্যটকদের আনাগোনা কম, সেখানে আছে সাগরলতা।
সৈকতের বেলাভূমি আঁকড়ে ধরা লতাগুলো সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে সমুদ্রতীর রক্ষা করে। ফলে কিছুটা হলেও ভাঙন থেকে রক্ষা পায় উপকূলের বেলাভূমি। সৈকতে মাটির ক্ষয়রোধ এবং শুকনো উড়ন্ত বালুরাশি আটকে রেখে বালিয়াড়ি তৈরির প্রধান কারিগর এই সাগরলতা।
গঙ্গামতি এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন জানান, আগে পুরো সৈকতে সাগরলতা রাজত্ব করেছে। কুয়াকাটায় পর্যটক আসতে শুরু করায় আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে এই উদ্ভিদ। করোনাকালীন কিছু কিছু জায়গায় সাগরলতা জন্ম নিয়েছিল। পরে পর্যটকদের পদচারণে এবং বর্ষা মৌসুমের অস্বাভাবিক ঢেউয়ের ঝাপটায় হারিয়ে গেছে। তবে এখনো কিছু কিছু জায়গায় সাগরলতা আছে।
সাগরলতার বিস্ময়কর জীবনচক্র আছে। এই লতা একধরনের বালুকাময় উপকূলীয় উদ্ভিদ, যা শিকড় দিয়ে শক্তভাবে বালু আঁকড়ে ধরে। গ্রীষ্মের প্রখর রোদ, লোনা বাতাস আর ঢেউয়ের ঝাপটাÑ সবকিছু সহ্য করেও এর সবুজ পাতাগুলো টিকে থাকে। এর বেগুনি ফুল সৈকতের রূপে যোগ করে আলাদা রঙের ছোঁয়া। বালুর ভেতরে শিকড় যত দূর যায়, ততটাই মজবুত হয় বালিয়াড়ি। এ কারণে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় সাগরলতা উপকূলকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
স্থানীয় শিক্ষিত যুবক মো. আল-আমিন হোসেন বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকে দেখছি, এই সাগরলতা না থাকলে বালু উড়ে যেত, ঝড়ে সৈকত ভাঙত। এখন অনেক জায়গায় মোটরসাইকেল চালানোয় লতা-পাতা, ফুল নষ্ট হয়। এগুলো বন্ধ করা খুবই জরুরি।’
সাগরলতা সৈকতের ক্ষয়রোধে সবচেয়ে কার্যকর প্রাকৃতিক বাঁধ। ঢেউয়ের তীব্রতা বালিয়াড়িতে পৌঁছানোর আগে সাগরলতা তা কিছুটা কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া এই গাছ পাখি, প্রজাপতি ও ছোট কীটপতঙ্গের জন্য আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে। কুয়াকাটা সৈকতের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাগরলতার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দুঃখজনকভাবে কুয়াকাটার সাগরলতা এখন নানা হুমকির মুখে। উপকূলের জেলে ও পর্যটকদের অসচেতন পদচারণা, সৈকতে মোটরবাইক রেসিং, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা কারণে সাগরলতার বিস্তৃতি ধীরে ধীরে কমছে। স্থানীয় পরিবেশবিদেরা বলছেন, সাগরলতা একবার ধ্বংস হলে তা স্বাভাবিকভাবে ফিরতে কয়েক বছর সময় লাগে। অথচ প্রতিদিনই এর নতুন নতুন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকার পর্যটক রিয়াদ ও মুন্নি। কথা হয় তাদের সঙ্গে। তারা বলেন, ‘আমরা প্রথমবার কুয়াকাটায় এসে সবুজ গাছ দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ছবি তোলার জন্য অসাধারণ। কিন্তু দেখলাম অনেকেই হেঁটে নষ্ট করছে। এটা খুব খারাপ লাগল।’
পরিবেশবিদ, স্থানীয় প্রশাসন ও পর্যটন কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সাগরলতা রক্ষা করা সম্ভব নয়। সৈকতের নির্দিষ্ট অংশে ‘সাগরলতা সংরক্ষণ অঞ্চল’ ঘোষণা করা, পর্যটকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং বালিয়াড়িতে যানবাহন চলাচল বন্ধ করা জরুরি। এখনই উদ্যোগ না নিলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে কুয়াকাটার সাগরলতা শুধু পুরোনো ছবির গল্পে রয়ে যাবে।
কুয়াকাটা প্রেসক্লাবে সভাপতি ও পরিবেশকর্মী রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘সাগরলতা কুয়াকাটা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এটি হারালে সৈকতের ক্ষয় দ্রুত বাড়বে। তাই নির্দিষ্ট এলাকাকে সংরক্ষিত ঘোষণা এবং সচেতনতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।’
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর কলাপাড়া উপজেলা সমন্বয়কারী মেজবাহ উদ্দিন মাননু বলেন, ‘অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের চাপে সাগরলতা বিলুপ্ত হচ্ছে। সমুদ্রসৈকত এলাকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার জন্য পর্যটকদের বাধাহীন বিচরণ বন্ধ করতে হবে। জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি, পরিবেশবাদী সংগঠনসহ সবার সমন্বিত উদ্যোগে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সাগরলতার জন্য সংরক্ষিত জোন করতে হবে।’
কুয়াকাটার সাগরলতা কেবল এক টুকরো সবুজ নয়, এটি উপকূলের প্রাকৃতিক ঢাল, সৌন্দর্যের অলংকার এবং জীববৈচিত্র্যের অভিভাবক। এটিকে রক্ষা করা মানে কুয়াকাটা সৈকতের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন