ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাকসু নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নির্বাচন কমিশন গঠনের সাড়ে ৩ মাস পর নানান পক্ষের চাপে ঘোষণা করা হয় নির্বাচনের তফসিল। ঘোষিত তফসিল ইতিমধ্যে দুইবার পুনর্বিন্যাস করা হয়েছে। নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পিএসসিতে নিয়োগ, ছাত্রদলের ‘সদিচ্ছার অভাব’ ও ২৪ আগস্ট থেকে নির্বাচনের মনোনয়নপত্র বিতরণের দিনগুলোতে পোষ্য কোটা নিয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দিনব্যাপী ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি রয়েছে।
ছাত্রনেতারা বলছেন, রাকসু নিয়ে প্রশাসনের দেওয়া প্রতিশ্রুতি বারবার পরিবর্তন হচ্ছে। পোষ্য কোটা পুনর্বহালের দাবিতে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা প্রশাসনকে সময় বেঁধে দিয়েছেন। রাকসুর প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকছে না। এতে রাকসুর নির্বাচনে ‘কালো মেঘের’ ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে।
তবে এসব কারণে নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় কোনো প্রভাব পড়বে না। নির্ধারিত সময়েই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
দুইবার পুনর্বিন্যস্ত হলো তফসিল :
নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রায় সাড়ে ৩ মাস পর বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন গত ২৮ জুলাই নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা করে। তফসিলে ১৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। নির্বাচনের তারিখ অপরিবর্তিত রেখে গত ১৩ আগস্ট তফসিল প্রথমবার পুনর্বিন্যাস করা হয়। গত ২০ আগস্ট মনোনয়নপত্র বিতরণ করার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন রাত সাড়ে ১১টার পর মনোনয়নপত্র বিতরণ স্থগিত করা হয়। পরে গত বুধবার বিকেলে নির্বাচনের তারিখ ঠিক রেখে তফসিল পুনর্বিন্যাস করা হয়। পুনর্বিন্যাসিত তফসিল অনুযায়ী, মনোনয়নপত্র বিতরণ ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট; মনোনয়নপত্র দাখিল ২৭ থেকে ২৮ আগস্ট; ৩১ আগস্ট ও ১ সেপ্টেম্বর মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ হবে ২ সেপ্টেম্বর। পরে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। সর্বশেষ ৪ সেপ্টেম্বর প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
শিক্ষকদের কর্মসূচি:
এদিকে নির্বাচনি আয়োজনের মধ্যেই পোষ্য কোটা পুনর্বহালের দাবিতে গত মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে চতুর্থ দিনের মতো কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এতে মনোনয়নপত্র বিতরণ পেছাতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। পোষ্য কোটা নিয়ে কর্মসূচি চলবে বলে জানা গেছে। শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াতের প্রধান সারির শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রয়েছেন। ২৩ আগস্টের মধ্যে দাবি মানা না হলে ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট পর্যন্ত দিনব্যাপী কর্মবিরতিসহ ধর্মঘট পালন করা হবে।
নির্বাচনের মধ্যে কর্মসূচি নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকের প্রশ্ন উঠেছে। তবে রাকসুর কর্মসূচির সঙ্গে রাকসু নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই মন্তব্য করে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের সভাপতি ও এগ্রোনমি এন্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল আলিম বলেন, ‘আমরা আমাদের অধিকারের যৌক্তিক সমাধান চাই।’
নির্বাচন নিয়ে তড়িঘড়ি চায় না ছাত্রদল:
শাখা ছাত্রদলের নেতাদের দাবি, রাকসু নিয়ে ছাত্রদলের দাবিগুলো প্রশাসন আমলে নেয়নি। শিবির ছাড়া নীতিগত ভূমিকায় কেউ নেই। প্রশাসন নিরপেক্ষ থেকে আস্থা অর্জন করুক। ছাত্রসংগঠনগুলোর যৌক্তিক দাবি প্রশাসন মেনে নিক। তড়িঘড়ি নির্বাচন না করে সব কিছু সুষ্ঠুভাবে অনুসরণ করে তারা নির্বাচন দিক। না হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এই প্রহসনমূলক নির্বাচন মেনে নেবে না।
একাধিক সূত্র বলছে, কিছুদিন আগেও শাখা ছাত্রদলের শীর্ষ নেতাদের নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল না। তবে দলের উচ্চ মহলের সিদ্ধান্তে অংশ নিতে হচ্ছে। কিন্তু যোগ্য প্রার্থীর অভাব নিয়ে তারা দোটানায় রয়েছে। বিষয়টি অস্বীকার করে শাখা ছাত্রদলের সভাপতি সুলতান আহমেদ রাহী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব। তবে তা তড়িঘড়ি নয়। শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার পরে। এতে আমরা নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন চাই।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পিএসসিতে পদায়ন
মনোনয়নপত্র বিতরণের মাত্র তিন দিন আগে রাজশাহী রাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। নির্বাচন কমিশনারের আকস্মিক বদলিতে নির্ধারিত সময়ে রাকসু নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন ক্যাম্পাসের ছাত্রনেতারা।এ বিষয়ে অধ্যাপক আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমি আলোচনার মাধ্যমে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। উপাচার্য দ্রুতই নতুন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবেন।’
ছাত্রনেতা ও অংশীজনদের মন্তব্য:
মনোনয়নপত্র বিতরণের মাত্র আগে এমন পরিস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ক্যাম্পাসের সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলো। তারা বলছে, যখন দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নির্বাচনের একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে, ঠিক তখনই এমন একটি ঘটনা ঘটল। এটি নির্বাচন প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত এবং বানচাল করার একটি কৌশল হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, ‘আমরা মনে করি, কোনো সংঘবদ্ধ শক্তি নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করছে। এই ষড়যন্ত্র সম্ভব হচ্ছে প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগে।’
ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি মেহেদী মারুফ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের যদি এখন রদবদল হয়, তবে তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে কি না প্রশ্ন থেকেই যায়। আবার পোষ্য কোটা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন চলছে। এতে আমাদের মাঝে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।’
রাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাবেক সভাপতি নোমান ইমতিয়াজ। তার মতে, ত্রিমুখী এই চাপ রাকসু বানচাল করার পরিকল্পিত চেষ্টা। তিনি বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে রাকসু নির্বাচনে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে।’
ছাত্রশিবিরের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদ বলেন, ‘নির্বাচনে নানা বাধা আসছে। এটা কাম্য নয়। নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন দিতে হবে। অন্যথায় আমরা এটা একটা দলের প্রভাব হিসেবে বিবেচনা করব।’
এদিকে তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনি কাজ সম্পন্ন হবে বলে জানিয়েছেন আরেক নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এনামুল হক। তিনি বলেন, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারের রদবদলে নির্বাচনের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। প্রশাসন দ্রুতই নতুন কাউকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেবে। এমনও হতে পারে, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মধ্য থেকেই কাউকে দায়িত্ব দেবে। মনোনয়নপত্রও নির্ধারিত ২৪ তারিখ থেকেই বিতরণ শুরু হবে।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে বিভিন্ন আন্দোলন চলছে। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সমাধানের চেষ্টা করছি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পিএসসিতে নিয়োগ কোনো প্রভাব ফেলবে না। যথাসময়েই রাকসুর কার্যক্রম শেষ করতে পারব।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন