রাতটিকে ছোটখাটো মহাপ্রলয়ের মতো মনে হচ্ছিল। ভূমিকম্পটি এতটাই তীব্র ছিল, আবার কম্পনের পরপরই প্রচ- বাতাস বইতে শুরু করে, হালকা বৃষ্টিও পড়ে। আমার সন্তানরা ভয়ে চিৎকার করতে করতে আমাকে জাপটে ধরেছিল। চারদিকে ধুলোয় ভরে গিয়েছিল।’ বলছিলেন আফগানিস্তানের কুনারের সোকাই জেলার বাসিন্দা ইজ্জাতুল্লাহ সাফি। তিনি জানান, ভূমিকম্পে তার বাড়ির একাংশ ধসে পড়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘মোবাইল নেটওয়ার্ক তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমরা আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং বিদ্যুৎ না থাকায়, আমরা ফোনের টর্চলাইটের ওপর নির্ভর করেছিলাম।’ ইজ্জাতুল্লাহ জানান, সকালে সরকারি হেলিকপ্টার এসে আহতদের পাহাড় থেকে কুনার মহাসড়কে নামিয়ে আনে, সেখান থেকে তাদের গাড়িতে করে ক্লিনিকে পাঠানো হয়। বিদ্যুৎ নেই, সারা দিন বাজারও বন্ধ ছিল। তা ছাড়া আফগানিস্তানের ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকা এখনো দুর্গম। পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত গ্রামগুলোতে পৌঁছাতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে, যা উদ্ধার কার্যক্রমকে আরও কঠিন করে তুলেছে।
আফগানিস্তান ভূমিকম্পপ্রবণ একটি দেশ। বিশেষত হিন্দুকুশ পর্বতমালায় প্রায়ই বড় ধরনের ভূমিকম্প আঘাত হানে। এ অঞ্চলে ভারতীয় ও ইউরেশীয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থল হওয়ায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি বেশি। গত রোববার মধ্যরাতের ঠিক আগে, ৬.০ মাত্রার একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে পূর্ব আফগানিস্তানে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এতে অন্তত ১৪শর ওপর মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাঙ্গারহার ও কুনার প্রদেশ। রাস্তাঘাট বন্ধ থাকায় দুর্গম পাহাড়ি গ্রামগুলোতে তালেবান সরকারের উদ্ধার অভিযান এখন মূলত হেলিকপ্টারনির্ভর। তবে এখনো কিছু দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
‘ধুলোমাখা মুখে মানুষগুলো যেন রোবটের মতো নিথর হয়ে বসে আছে। তারা এতটাই বাকরুদ্ধ যে, কেউ এ নিয়ে একটি কথাও বলতে পারছে না। চারদিকে এক ধরণের গভীর নিস্তব্ধতা গ্রাস করে আছে।’ বলছিলেন আফগানিস্তানের প্রত্যন্ত কুনার প্রদেশের বাসিন্দা মতিউল্লাহ শাহাব, যিনি নিজেই একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী।
ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে শাহাব নিজেই মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে দেখেন তার বাড়িঘর প্রবলভাবে কাঁপছে। দেয়াল ভেঙে পড়ার ভয়ে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে সারা রাত বাগানে জেগে কাটান। ‘আমরা সবাই খুব ভয় পেয়েছিলাম,’ বলেন শাহাব। ভোর হতে না হতেই তিনি নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকার উদ্দেশ্যে। কিন্তু রাস্তাগুলো পাথরে ভরে থাকায় তাকে গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে প্রায় দুই ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলোতে পৌঁছতে হয়। ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নাঙ্গারহার ও কুনার প্রদেশ। তবে এর কম্পন কাবুল এবং প্রতিবেশী পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ পর্যন্ত অনুভূত হয়েছে।
তিনি যখন আন্দারলাচাক গ্রামে পৌঁছেন, তখন দেখেন কয়েকজন ছোট্ট শিশুকে রাস্তায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। বুকে ও মুখে আঘাতের চিহ্ন নিয়ে দুটি ছোট্ট শিশু একটি স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। অন্য শিশুদের সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। শুধু এই গ্রামেই মারা গেছেন ৭৯ জন। মতিউল্লাহ বলেন, ‘আমি অনেক মৃতদেহ দেখেছি। ১৭ বার আফটারশক অনুভব করেছি।’ ভূমিকম্পে মৃত অসংখ্য মানুষের জন্য কবর খুঁড়তে স্থানীয়দের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন মতিউল্লাহ। তিনি বলেন, ‘আমি যে গ্রামগুলো পরিদর্শন করেছি, সেগুলো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।’ শাহাবকে এক ব্যক্তি জানান, তিনি তাঁর স্ত্রী ও চার সন্তানকে হারিয়েছেন। তবে অধিকাংশ মানুষ এতটাই শোকাহত ও হতবিহ্বল ছিলেন যে তাদের কথা বলার শক্তিটুকুও ছিল না। রাস্তাঘাট বন্ধ থাকায় তালেবান সরকারের উদ্ধার অভিযান মূলত হেলিকপ্টারনির্ভর হয়ে পড়েছে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে পৌঁছানোর জন্য। কিন্তু দুর্গম ও পাহাড়ি ভূখ-ের কারণে এখনো কিছু জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এর মধ্যেই উদ্ধারের অপেক্ষায় ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে অনেকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন, এমন খবরও আসছে অহরহ। শাহাব জানান, স্বেচ্ছাসেবকরা আটকা পড়া মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। তিনি নিজে দুটি বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে দুই নারীকে উদ্ধার হতে দেখেছেন। তবে উদ্ধারাভিযানের সময় নারীদের ছবি তোলার অনুমতি তাকে দেওয়া হয়নি, কারণ তালেবান নারীদের ছবি তোলার অনুমতি দেয় না। মতিউল্লাহ আরও বলেন, বহু বাসিন্দা এখন খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন।
তালেবান সরকারের আরোপিত নানা বিধি-নিষেধের কারণে আফগানিস্তানে ভূমিকম্প-পরবর্তী সময়ে নারীদের ও মেয়েদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা আরও বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা কেয়ারের আফগানিস্তান শাখার প্রধান গ্রাহাম ডেভিসন বলেন, এই বিধি-নিষেধের ফলে নারীদের জীবনরক্ষাকারী সেবায় প্রবেশাধিকার সীমিত হয়ে পড়েছে। ফলে ভূমিকম্পের পর নারীরা ও মেয়েরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। কুনার একটি অত্যন্ত রক্ষণশীল এলাকা। সাংস্কৃতিক কারণে সেখানে নারীরা চিকিৎসা দেরিতে পান। ধারণা করা হচ্ছে, কিছু নারী হয়তো হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পরিবারের অপেক্ষা করেছে। অথবা রাতের বেলা নয়, দিনের আলো ফোটার পর চিকিৎসার জন্য গেছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন