রবিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ১২:১৪ এএম

বেড়জাল, গড়াজালে ধ্বংস সাগরের জীববৈচিত্র্য

কাজী সাঈদ, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ১২:১৪ এএম

জীববৈচিত্র্য

জীববৈচিত্র্য

সাগরের জোয়ারে প্লাবিত উপকূলের নদী, খাল ও সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ¯্রােত কমে যাওয়ার পর শুরু হবে ভাটা। দুপুরের আকাশে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা। জোহরের আজান হয়নি তখনো। জেলে জামাল হোসেন ও তার সহযোগী আব্বাস প্যাদা লম্বা পায়ে হাঁটছেন গঙ্গামতি লেকের পাড়ে। সামনে একটা ছোট নৌকা। নৌকায় বেশ কিছু গাছের খুঁটি আর গোছাবাঁধা জাল। দুজনে নৌকায় উঠে বৈঠা চালাচ্ছেন। গঙ্গামতি চরে নৌকা থামিয়ে গাছের খুঁটি পুঁতে উঁচু করে বেঁধে দিলেন ছোট ফাঁসের গড়াজাল। এরপর একটি গাছের ছায়ায় নৌকা নোঙর করে অপেক্ষা করছেন। ভাটার ¯্রােতে পানি কমে গেলেই মাছ ধরবেন। 

আব্বাস প্যাদা হাসিমুখে জামাল হোসেনকে বলছেনÑ ‘চাচা, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পানি নাইম্মা যাইবে। মাছগুলো জালের পাশে পইরা থাকবে। বাইরাইয়্যা যাওয়ার পথ নাই।’ কথাগুলো বলছিলেন আনন্দ আর গর্বের সুরে। কিন্তু তার এই আনন্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক নীরব অপরাধ। একটি ফাঁদ, যেটা শুধু মাছ নয়, ধ্বংস করছে সাগরের ভবিষ্যৎ। 

জোয়ারের সময় নদী, খাল ও বনাঞ্চল প্লাবিত হয়। সেই পানিতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও মাছের পোনা উঠে আসে তীরে। মাছেরা যখন জোয়ারের নতুন পানিতে খাবার খুঁজতে থাকে, তখন তাদের ধরার জন্য ফাঁদ পাতা হয়। ভাটার ¯্রােতে পানি নেমে শুকিয়ে যায়। মাছগুলো জালের ফাঁদে আটকে পড়ে। এই জালই হলো ‘গড়াজাল’। একই ফাঁসের জাল দিয়ে তৈরি হয় ‘বেড়জাল’।

এদিকে গঙ্গামতি সৈকতের তেত্রিশকানি নামক জায়গায় গাছের নিচে বসে মোবাইলে লুডু খেলছেন চার জেলে। পাশে একটি বড় পাতিল আর এক গুচ্ছ জাল। ভাটার পানি নামলেই সাগরে নামবেন বেড়জাল টানতে। এ জাল মূলত সমুদ্রের কিছুটা ভেতরে ফেলে কিনারে টেনে তোলা হয়। তাদের মধ্যে একজন আব্দুস সোবাহান। তিনি বলেন, ‘আগের মতো সাগরে মাছ নাই। মাছ কইম্মা গ্যাছে।’ 

কেন কমে গেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ট্রলিং ট্রলারের বেন্দি জালে সব শ্যাষ কইয়্যা দিছে।’ বেড়জালে মাছ শেষ হয় না, উত্তরে তিনি বলেন, ‘মোরা আর কয়ডা মাছ ধরি। হারাদিনে ৫টা খেও দেতে পারি। মাছ যা পাই হ্যাতে সংসার চলে না। এ জাল আর বেশিদিন বামু না। অন্য কাম করমু।’

সরেজমিনে দেখা গেছে, পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার নদী ও সাগরবেষ্টিত প্রতিটি চর ও মোহনায় গড়াজাল ও বেড়জালের আধিপত্য। তবে বর্ষা মৌসুমে এ জালের ব্যবহার কিছুটা কম থাকে। সাগরের ঢেউ কমে গেলেই এসব জাল নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে উপকূলের জেলেরা। গড়াজাল এক ধরনের স্থায়ী বা আধা স্থায়ী ফাঁদ। খাল, নদী, সাগরের তলদেশে পোক্তভাবে বাঁশ বা খুঁটি পুঁতে পাতা হয় বিশাল জাল। যেখান মাছ ঢুকলেও বের হতে পারে না। এই জাল সাধারণত ২০ থেকে ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যরে হয়ে থাকে। অনেক সময় একাধিক গড়া একসাথে পাতা হয়। উপকূলের প্রত্যেকটি গ্রামের জেলেরা এ জাল পেতে মাছ শিকার করেন।

মহিপুর থানার ধুলাশার ইউনিয়নের আশাখালী এলাকার বয়স্ক জেলে লোকমান মৃধা বলেন, ‘আইনে অবৈধ হলেও গড়া জালের ব্যবহার কমছে না, বরং দিন দিন বাড়ছে। কারখানা বন্ধ করলেই এ জাল দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ হবে। বন্ধ করার উপায়ও বা কী, প্রশাসনও তো টাকা খায়।’

বেড়জাল ও গড়াজালের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো পোনা নিধন। এসব জালে মাছের পোনা ঢুকে আর বের হতে না পেরে মারা যায়। প্রতিবছর বেড়জাল আর গড়াজালের ফাঁদে কয়েক হাজার টন মাছের পোনা নিধন হয়। কুয়াকাটা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা চরবিজয়েও এ জাল ব্যবহার হচ্ছে। আর নির্বিচারে মারা পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছের পোনা। এসব পোনা আকারে এতই ছোট যে বাজারে বিক্রির উপযোগী নয়। ফলে জেলেরা জালে আটকা বড় মাছ রেখে প্রতিদিন কয়েক মণ পোনা সমুদ্র্রে ফেলে দেন। সাগরের মাঝখানে এসব বেড়জাল ও গড়াজাল মাছেদের জন্য যেন একেকটি ‘জলজ কারাগার’, যেখানে আটকা পড়লে ফিরে আসার কোনো পথ থাকে না। 

চরবিজয়ে মাছ ধরেন জেলে আবু তালেব। তিনি জানান, বর্ষায় চরবিজয়ে জাল পাতা যায় না। শীত মৌসুমে একেকটি বেড়জাল ও গড়াজাল দিয়ে দৈনিক ১০ থেকে ১২ মণ মাছ পাওয়া যায়। বড়-ছোট সব ধরনের মাছ ওঠে এসব জালে। মাছের পোনা সমুদ্রে ফেলে দেন তারা। যাতে মাছগুলো মারা না যায়। কিন্তু সব সময় তা করা সম্ভব হয় না। 

কুয়াকাটা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বিকাশ ম-ল বলেন, ‘গভীর সমুদ্রে অভিযান চালানোর নৌযান নেই আমাদের। আমরা ভাড়া করা নৌযান নিয়ে অভিযানে নামলে, জেলেরা আগেই খবর পেয়ে পালিয়ে যায়।

‘মৎস্য সংরক্ষণ আইন ১৯৫০’ অনুযায়ী এ জাল সম্পূর্ণ অবৈধ। ‘সামুদ্রিক মৎস্য আইন ২০২০’ অনুযায়ী স্থায়ী বাধা তৈরি করে মাছ ধরা শাস্তিরযোগ্য অপরাধ। কিন্তু আইনের প্রয়োগ না থাকায় বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ বেড়জাল ও গড়াজাল। ফলে সাগর-নদীর জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। ছোট ও ডিমওয়ালা মাছ ধরার ফলে সামুদ্রিক মাছের প্রজননচক্র ব্যাহত হচ্ছে। সঠিক নজরদারির অভাবে বাড়ছে এই অপরাধ।

গঙ্গামতি এলাকার বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘বেড়জাল ও গড়াজাল বন্ধ হবে না। প্রশাসন মাসিক মাসোয়ারা নেয়। যে কারণে স্থানীয়রা অভিযোগ করলেও পুলিশ এসে কিছু পায় না। পুলিশ আগেই তাদের খবর দিয়ে আসে।’

অপর এক জেলে বলেন, ‘লাইসেন্স করে, বৈধ জাল কিনে লাভ নাই। প্রশাসন টাকা পেলে চুপ থাকে, না পেলে অভিযান চলায়।’

সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট মাছ ও ডিমওয়ালা মাছ ধরা বন্ধ না হলে অদূর ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগরে মাছের উৎপাদন অনেকটাই কমে যাবে। এ ছাড়া জেলেরা দীর্ঘমেয়াদি জীবিকা ঝুঁঁকির মধ্যে পড়বে। নিষিদ্ধ জাল উৎপাদন ও বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে। সাগর ও নদীতে নিয়মিত টহল এবং অভিযানের পরিমাণ বাড়াতে হবে। বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা করে অবৈধ জাল ব্যবহারকারীদের ফিরিয়ে আনতে হবে। সচেতনতা কার্যক্রম জোরালো করার পরামর্শ তাদের।

ওয়ার্ল্ডফিশের গবেষণা সহকারী বখতিয়ার রহমান বলেন, ‘এসব জাল খুব ঘন হওয়ায় ছোট মাছ, ডিমওয়ালা মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি ইত্যাদি আটকা পড়ে। ছোট মাছ বড় হওয়ার সুযোগ পায় না এবং মা মাছ ধরার কারণে প্রজননচক্র বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মাছের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে মাছের পরিমাণ কমে গেলে সাধারণ জেলে পরিবার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পোনা ও বিভিন্ন স্তরের প্রাণী কমে গেলে জলজ খাদ্য শৃৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের ওপর প্রতিকূল প্রভাব পড়বে।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড দক্ষিণ জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট (বিএন) আবুল কাশেম বলেন, ‘বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক নিষিদ্ধঘোষিত সব ধরনের জালের ব্যবহার বন্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। নিয়মিত মৎস্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান পরিচালনা করা হয়। যার মাধ্যমে বাংলাদেশ মৎস্য আইন ১৯৫০ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন অনুসারে অবৈধ জাল জব্দ ও ধ্বংস এবং ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ পদক্ষেপসহ স্থানীয় জেলেদের মধ্যে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধে উদ্বুদ্ধ করে আসছে।     

এ প্রসঙ্গে কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘বেড়জাল ও গড়াজাল বন্ধে আমরা মৎস্য প্রশাসন যথেষ্ট সচেতন আছি। বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে এ জাল ধ্বংস করছি। তারপরও একশ্রেণির জেলেরা এ জাল ব্যবহার করছে। তবে জনবল সংকটের কারণে নিষিদ্ধ এসব জালের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না।’  

জেলে জামাল হোসেনের চোখে বেড়জাল ও গড়াজাল উপার্জনের অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সাগরের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এসব জালের ব্যবহার ভবিষ্যতে ধ্বংসই ডেকে আনবে। নিষিদ্ধ এই জালের প্রচলন চলতে থাকলে একদিন হয়তো শুধু জালই থাকবে, নদী-সাগরে মাছ থাকবে না। থাকবে না উপকূলের জীবিকা, থাকবে না সাগরের প্রাণ।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!