শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ০৮:৩৭ এএম

মেধা পাচার বনাম রাষ্ট্রের দায়

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৫, ২০২৫, ০৮:৩৭ এএম

রাষ্ট্রের দায়

রাষ্ট্রের দায়

মানুষ স্বভাবতই উন্নত জীবনযাপন, নিরাপদ ভবিষ্যৎ ও মানসম্মত কর্মসংস্থান প্রত্যাশা করে। রাষ্ট্র যখন জনগণের মেধা, দক্ষতা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কর্মসংস্থান এবং নিরাপদ পরিবেশের ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয় তখন নাগরিকদের মাঝে এক ধরনের হতাশা সৃষ্টি হয়। তখন দেশের প্রতিভাবান এবং দক্ষ ব্যক্তিরা উন্নত জীবনযাপনের জন্য জন্মভূমি ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমান। জন্মভূমি ছেড়ে দীর্ঘমেয়াদে বা স্থায়ীভাবে বিদেশে পাড়ি জমানোকে আমরা মেধা পাচার বলে সংজ্ঞায়িত করি। শিক্ষক হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে সরাসরি মনের ভাব বুঝার সুযোগ হয়। যখন জানতে পারি একজন শিক্ষার্থী স্নাতক সম্পন্ন করার পর স্থায়ীভাবে দেশের বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন লালন করছে তখন দেশের ভবিষ্যতের জন্য হতাশা সৃষ্টি হয়।

দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এখন তো আমার অনেক উচ্চ মাধ্যমিক পড়ুয়া শিক্ষার্থী স্নাতক স্তরেই দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সবাই কি সুখে যাচ্ছে?  না,  অনেকেই চলে যাচ্ছে দেশের দীর্ঘদিনের অচলায়তনে তিক্ত বিরক্ত হয়ে। কে চায় বলুন নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎকে সিস্টেমের বেড়াজালে জলাঞ্জলি দিতে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমানোর পেছনে যতটা না অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি লাভের চিন্তা কাজ করে তার চাইতেও বেশি ভূমিকা রাখে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ থেকে ৫২ হাজার ৭৯৯ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য বিদেশে গেছে। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এই সংখ্যা ছিল ৪৯ হাজার ১৫১ জন এবং ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন। আর ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে বিদেশে গিয়েছিল ২৪ হাজার ১১২ জন শিক্ষার্থী।

অর্থাৎ ১০ বছরের ব্যবধানে এই সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হয়েছে; যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করেন এ সংক্রান্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ কাউন্সিলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশটিতে শিক্ষার্থী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ‘রাইজিং স্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশিদের বিদেশে শিক্ষার ব্যয় ছিল ৬৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। বাংলাদেশি মুদ্রায় ব্যয়কৃত এ অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৭৯ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। কেবল ব্যয় নয়, বরং সংখ্যার দিক থেকেও সর্বোচ্চসংখ্যক শিক্ষার্থী বিদেশ পাড়ি দিয়েছেন।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ব্যয় ছিল ৫৩ কোটি ৩২ লাখ ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫২ কোটি ৮ লাখ ডলার, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৪ কোটি ৩১ লাখ ডলার অর্থাৎ পাঁচ বছরের ব্যবধানে এ ব্যয় আড়াই গুণের বেশি বেড়েছে। আর শুধু বিগত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১২ কোটি ৮৮ লাখ ডলার। প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষার্থীরা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে, এটি আপাত অর্থে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে।

কিন্তু এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর দেশে ফেরত না আসা অথবা দেশে তাদের জন্য ভালো কোনো সুযোগ সৃষ্টি করতে না পারা ভবিষ্যতকে হুমকির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দক্ষ জনশক্তি একটি দেশের সম্পদ। প্রতিটি দেশের লক্ষ্য থাকে তার জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করা। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থা জনশক্তির চাইতে যেন রাজনৈতিক পেশিশক্তি বাড়াতেই বেশি আগ্রহী। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি এত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, যার কারণে শিক্ষা পরিবেশ চরমভাবে বিঘিœত হচ্ছে। যার কারণে উন্নত জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, উচ্চ বেতনের নিশ্চয়তা এবং গবেষণার জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা পেতে তরুণ প্রজন্ম বিদেশমুখী হচ্ছে। দীর্ঘ সময় লালন করে যে মেধা রাষ্ট্র তৈরি করেছে সেই মেধা অভিবাসী হওয়ায় প্রতিবছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে ঠিক কিন্তু এই আর্থিক সুবিধা দিয়ে পাচার হওয়া মেধার ঘাটতি পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।

বিশ্বায়নের এই যুগে অভিবাসনকে স্বাভাবিক পক্রিয়া মনে করা হলেও দীর্ঘমেয়াদে এর নেতিবাচক প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা বেশিই আত্মঘাতী। বহু কষ্টে সীমিত সম্পদ দিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ তৈরি করা হয় অথচ সেই বিনিয়োগের ফল ভোগ করে উন্নত দেশগুলো। দেশের প্রতিভাবান এবং দক্ষ ব্যক্তিরা যখন মেধা, যোগ্যতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা সবই নিয়ে গিয়ে অন্য দেশকে দিচ্ছেন। তখন দেশমাতৃকার মুখখানা মলিন হওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর খোলা থাকে না।

প্রতিবছর হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া বা কানাডায় চলে যাচ্ছে। তাদের বড় একটি অংশ আর দেশে ফিরে আসে না। মধ্যপ্রাচ্যের বহু দেশ অর্থনৈতিক কারণে বিদেশি শ্রমশক্তির উপর নির্ভরশীল। কর্মসংস্থানের জন্য বাংলাদেশ থেকে বহু দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিক সেসব দেশে গেলেও একসময় ফিরে আসে কিন্তু আমেরিকা ও ইউরোপগামী দক্ষ মেধাবী শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও গবেষকগণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ফিরে আসেন না। এই ফিরে না আসার পেছনে দায়ী মূলত রাজনৈতিক অস্থিরতা বা কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতা। মেধা পাচারের ফলে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো অতিরিক্ত মানবসম্পদ অর্জন করছে। আর আমরা দেশে মানবসম্পদের ঘাটতিতে ভুগছি। দেশের নাগরিকদের ঘাম ঝরানো করের টাকায় সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনা শেষ করে একজন মেধাবী সন্তান যখন দেশের বাইরে পাড়ি জমায় তখন সবচেয়ে বড় যে ক্ষতি হয়, তা হলো অর্থনৈতিক ক্ষতি।

কারণ তাকে শিক্ষিত মানবসম্পদে পরিণত করতে বিপুল অর্থ ও সম্পদ রাষ্ট্র ব্যয় করে কিন্তু তার সুফল ভোগ করে ভিন্ন দেশ। রাষ্ট্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করে ৫ লাখ টাকা, একজন বুয়েটের শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করে ১০ লাখ টাকা আর একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর পেছনে ব্যয় করে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তাদের পেছনে এই অর্থ ব্যয় হয় জনগণের ঘামের টাকায়। মেধা পাচারের ফলে দেশের গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী পাচারের ফলে দেশের শিক্ষার মান দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।  

দেশীয় শিল্প ও গবেষণার খাতগুলোতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দিচ্ছে। দেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে শিক্ষার পরিবেশ বিঘিœত হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-রাজনীতি ও শিক্ষক-রাজনীতির ভয়াবহ রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করছি বিগত দুই দশক ধরে।, এই রাজনীতির শিকার হয়ে অনেক শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছেন। জীবনের নিরাপত্তাহীনতা ও সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের আশায় মেধাবীরা দেশ ছাড়ছে। দেশের একটি বিরাট অংশ ধরেই নেন যে তাদের মেধা, সৃষ্টিশীলতা ও যোগ্যতার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন এ দেশে সম্ভব নয়। উপরন্তু অস্থিতিশীল ও অসহনশীল নোংরা রাজনৈতিক কারণে দেশের ১৫-২৯ বছর বয়সি জনসংখ্যার ৮২ শতাংশই বিদেশে পাড়ি দিতে পছন্দ করে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশের জন্য দক্ষ জনবল গুরুত্বপূর্ণ।

বিশাল এই জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তর করা জরুরি। বাংলাদেশের অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে এ দেশের মেধাবীদের যথাযথ মূল্যায়ন না করা। বিজ্ঞানের অগ্রগতির এই যুগে যখন বিশ্বের সবকটি দেশই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে এবং বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রণোদনা বৃদ্ধিসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে তখন আমাদের দেশ বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগাতে পারছে না।

গবেষণা খাতে নেই উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ। শিক্ষকদের বেতন-ভাতার জন্য করতে হয় রাজপথে আন্দোলন। ফলে উদ্ভাবনী ক্ষমতা থাকলেও উদ্ভাবনের সুযোগ পাচ্ছেন না এ দেশের অসংখ্য উদ্ভাবনশীল বিজ্ঞানীরা। যার ফলে পাচার হচ্ছে মেধা। মেধা পাচার প্রতিরোধে বিশ্বমানের কারিকুলাম তৈরি ও গবেষণা ভিত্তিক শিক্ষা চালু, আধুনিক ল্যাব, লাইব্রেরি, ও ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দক্ষ শিক্ষক গড়ে তোলার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য ‘স্টার্টআপ ফান্ড’ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। সীমিত ভৌগোলিক আকারের এই সার্বভৌম ভূখ-ে আমাদের মূল সম্পদই হলো মানবসম্পদ,  সেই মানবসম্পদ যদি বিদেশে চলে যায় তাহলে আমাদের স্থায়ী উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই মেধা পাচার মোকাবিলায় কার্যকর নীতি গ্রহণ এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।

মো. তাহমিদ রহমান, শিক্ষক ও কলামিস্ট

 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!