ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে আগামীকাল মঙ্গলবার। ইতিমধ্যে ঘোষণা হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের ইশতেহার। শিক্ষার্থীদের মন জয় করতে সবাই ঘুরেফিরে নতুন করে পুরোনো প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। যা বাস্তবায়নই বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, এগুলো বাস্তবায়নে প্রশাসনের ভূমিকাই বেশি, ডাকসুর ভূমিকা কম।
অন্যদিকে এবারের নির্বাচনে ছাত্রীদের ভোট নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এবার নির্বাচনের প্রচারের মূল মঞ্চই যেন হয়ে উঠেছে ফেসবুক। সশরীর প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমেও সরব প্রার্থীরা। শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য ঢাবি প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এদিকে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে গতকাল রোববার হুইলচেয়ারে ঢাবি ক্যাম্পাসে এসে সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মেঘমল্লার বসু অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা ভোট দিতে এলে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটা পোস্টেও জিতে আসতে পারবে না।
ডাকসুর এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে দেখা যায়, ঘুরেফিরে এসেছে সেই পুরোনো প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল, ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, বামপন্থি জোট সমর্থিত ‘প্রতিরোধ পরিষদ’, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’, বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ সমর্থিত ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্যানেল ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্রায় একইরকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছে শিক্ষার্থীদের। সবাই জানাচ্ছেন ডাকসু ও হল নির্বাচন প্রতিবছর নিশ্চিত করা হবে, শিক্ষার্থীদের সবার জন্য পূর্ণাঙ্গ আবাসন নিশ্চিত করা হবে, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাসহ আরও চলমান ইস্যু তুলে ধরা হচ্ছে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে অনেকটি ডাকসুর এখতিয়ারভুক্ত নয়। সংবিধান অনুযায়ী, ডাকসুর দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে কমন রুম বজায় রাখা, ইনডোর গেমসের ব্যবস্থা করা, জার্নাল ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করা, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, বক্তৃতা ও সামাজিক সমাবেশ আয়োজন করা প্রভৃতি।
জয়ী হওয়ার পর প্রার্থীরা ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে পারবেন, নাকি কেবলই ভোটারদের মন জয় করার কৌশল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে শিক্ষার্থীদের। কারণ, প্রায় একই রকমের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত ইশতেহারে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে পরে ওই নির্বাচিত ডাকসু শিক্ষার্থীদের কল্যাণে তেমন কিছুই করতে পারেনি।
ইশতেহারে যে বিষয়গুলোতে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে: নিরাপদ খাদ্যÑ শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের খাদ্য নিরাপত্তায় ক্যান্টিন ও কাফেটেরিয়া বিষয়ে প্যানেলগুলো নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আবাসনÑ এটা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সব প্যানেল। প্রথম বর্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বৈধ সিট নিশ্চিতসহ রয়েছে নানা বাণী। স্বাস্থ্যসেবাÑ মেডিকেল সেন্টার আধুনিকায়ন, সার্বক্ষণিক ডাক্তার-অ্যাম্বুলেন্স-ফার্মেসি, বিনা মূল্যে জরুরি ওষুধ, হলে মেডিকেল কর্নার, স্বাস্থ্যবিমা, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে প্যানেলগুলো। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাÑ প্রায় সব প্যানেলই নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। নারী শিক্ষার্থীদের পোশাকের স্বাধীনতা, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, স্যানিটারি প্যাড ভেন্ডিং মেশিন, নারী চিকিৎসক, সান্ধ্য আইন বিলোপ ও রাত্রিযাপনের স্বাধীনতার কথা বলেছে।
জয়-পরাজয় নির্ধারণ করবে ছাত্রীরা:
এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রীদের ভোট জয়-পরাজয় নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখবে। ফলে সব প্যানেলের ইশতেহারেও ছাত্রীদের আবাসন সংকটসহ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এবার গুরুত্ব পেয়েছে। নির্বাচনে মোট ভোটার ৩৯ হাজার ৮৭৪ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ভোটার ১৮ হাজার ৯৫৯ জন। ফলে ছাত্রীদের ভোট ডাকসু নির্বাচনে বড় নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রচারের বড় মঞ্চ ফেসবুক:
ডাকসু নির্বাচনের প্রচারের মঞ্চ যেন হয়ে উঠেছে ফেসবুক। সশরীর প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন মাধ্যমেও সরব প্রার্থীরা। এখানে দেওয়া আধেয় (কনটেন্ট) টানছে ভোটারদের, ক্যাম্পাসে বাড়াচ্ছে আলোচনা। প্রার্থীরা বলছেন, ফেসবুকে শিক্ষার্থীরা বেশি সক্রিয়। সশরীরের চেয়ে অনলাইনে ভোটারদের কাছে অল্প সময়ে পৌঁছানো যায়। তাই তাঁরা সশরীর প্রচারের পাশাপাশি অনলাইন তথা ফেসবুক প্রচারেও গুরুত্ব দিচ্ছেন।
সর্বাত্মক সহযোগিতার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার:
প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম বলেছেন, ডাকসু নির্বাচন যেন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানান প্রেসসচিব।
সংবাদ সম্মেলনে মেঘমল্লারের আহ্বান :
নির্বাচনি প্রচার শুরুর দুই-একদিন পরই শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। গতকাল হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই হুইলচেয়ারে করে ঢাবির মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনে যোগ দেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে অনাবাসিক শিক্ষার্থীসহ সব ভোটারকে ভোট দিতে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা ভোট দিলে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটা পোস্টেও জিতে আসতে পারবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আহ্বান জানাতে চাই অনাবাসিক ভাইবোনদের, আপনারা যাঁকে খুশি তাকে ভোট দিন। কিন্তু আপনারা অবশ্যই ভোট দিতে আসবেন। আপনারা ভোট দিতে এলে এখানে যত সমীকরণ হচ্ছে, এর কিছুই দাঁড়াবে না। আপনারা ভোট দিতে এলে এখানে স্বাধীনতাবিরোধীরা একটা পোস্টেও জিতে আসতে পারবে না।’ গত ২৬ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে গতকাল রাত ১০টায় শেষ হচ্ছে ডাকসুর নির্বাচনি প্রচার।
এদিকে, ডাকসুতে নির্বাচিত হলে রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে আচরণে গণতান্ত্রিক মনোভাবের প্রতিফলন ঘটানোসহ আট বিষয়ে শপথ নিয়েছেন ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরা। গতকাল দুপুর ১টার দিকে ঢাবির কলা ভবনের সামনের বটতলায় প্রার্থীরা এই শপথ নেন। ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলসমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী মো. আবিদুল ইসলাম এই শপথবাক্য পাঠ করান।
প্রসঙ্গত, ডাকসু নির্বাচন কমিশন অপেশাদার আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের’ ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেছেন, অনেক বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ আছে, এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনের অপেশাদার আচরণ। আমরা অনেক অভিযোগ দিয়েছি, নির্বাচন কমিশন এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন