ঢাকা শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় নাকাল রাজধানীবাসী

শাওন সোলায়মান
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ১০:৪১ পিএম
বৃষ্টিতে ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ টার্মিনাল সংলগ্ন বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ছবি- রূপালী বাংলাদেশ

  • স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও ঢাকার ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা শোচনীয়
  • বিমানবন্দর এলাকাই ডুবে থাকে হাঁটুপানিতে
  • সময়মতো পৌঁছাতে না পারায় ফ্লাইট ধরতে পারেননি অনেকে
  • নিরসনে নানা পদক্ষেপ দুই সিটি করপোরেশনের
  • অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে জলাবদ্ধতা থাকবেই : বিশেষজ্ঞ

মাত্র ১৯ মিলিমিটারের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় নাকাল অবস্থা হয়েছে রাজধানীবাসীর। বৃহস্পতিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে শুরু হওয়া প্রায় দেড় ঘণ্টার বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ও এলাকায় হাঁটু সমান জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে ব্যাপক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় নগরবাসীকে।

জলাবদ্ধতার কারণে সড়কে পরিবহনের ধীরগতিতে যানজটও পোহাতে হয়। নগরবাসীদের জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে নানান পদক্ষেপ নেওয়ার কথা উল্লেখ করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে জলাবদ্ধতা এখন নিত্যদিনের সঙ্গী। এটাকে কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়, সেই প্রচেষ্টাই নিতে হবে কর্তৃপক্ষকে।

এদিকে ক্ষোভ প্রকাশ করে নগরবাসী বলছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখনো খোদ ঢাকা মহানগরীতে ড্রেনেজ সিস্টেম ও স্যুয়োরেজ ব্যবস্থাসহ আধুনিক মানের রাজধানী শহর গড়ে তুলতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি কোনো সরকার। তাই খোদ ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকাই ডুবে থাকে হাঁটপানিতে। বৃহস্পতিবারের বৃষ্টিতে সেখানে কোমরপানিতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন দেশি-বিদেশি যাত্রীরা।

বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীজুড়ে বৃষ্টি শুরু হয়। আবহাওয়া অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী, দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঢাকায় ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার টানা বৃষ্টিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকার মিরপুর, প্রগতি স্মরণী, বিমানবন্দর এলাকা, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, রাজাবাজার, নাখালপাড়া এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ধানমন্ডি, নিউমার্কেট, শিক্ষা বোর্ড এলাকা, হাজারীবাগ, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া এবং পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় হাঁটু পর্যন্ত জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এতে চলাচলে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়ে রাজধানীবাসী। অন্যদিকে জলাবদ্ধতার কারণে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে দেখা দেয় ব্যাপক যানজট। এতে সকালে জীবিকার তাগিদে ঘর থেকে বের হওয়া কর্মজীবীদের ব্যাপক হয়রানি পোহাতে হয়।

বেলা ১১টার দিকে মিরপুরের কালশী এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার চিত্র সরেজমিনে দেখা যায়। কালশী ফ্লাইওভার র‌্যাম্পের গোড়া থেকে সাংবাদিক প্লট পর্যন্ত এলাকা পুরোটাই পানিতে ডুবে ছিল। মূল সড়ক পেরিয়ে জলাবদ্ধতা দেখা যায় সাংবাদিক কলোনির ভেতরেও। এমন অবস্থায় জুতা খুলে আর প্যান্ট হাঁটুর ওপরে গুটিয়ে পানিতে হাঁটতে দেখা যায় অনেককে।

বনানীতে অফিসের উদ্দেশে বের হওয়া একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে অনেক জ্যাম থাকে, তাই একটু দেরি করে বের হই। দরজা খুলে বের হয়েই দেখি, বাসার দরজার সামনেই পানি জমে আছে। এখন পানিতে হেঁটেই কালশী মোড় পর্যন্ত যাচ্ছি, সেখান থেকে কোনো গাড়িতে উঠব।’

জহিরুল হকের যখন এই অবস্থা, তখন অনেককে জলাবদ্ধ এলাকা পার হতে হয়েছে বিকল্প উপায়ে। কেউ রিকশায়, কেউ মোটরসাইকেলে ১০০ মিটারের মতো পথ পাড়ি দিয়েছেন শুধু জলাবদ্ধতা থেকে বের হওয়ার জন্য। রাজধানীর বিমানবন্দর এলাকায় ডমেস্টিক টার্মিনাল সড়ক পুরোটাই ডুবে যায় পানিতে। এতে টার্মিনালে যানবাহন ঢুকতে এবং বের হতে না পারায় ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।

জানা যায়, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে হাজি ক্যাম্প পর্যন্ত সমন্বিত পথচারী আন্ডারপাস নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ চলছে। কিন্তু পানি নিষ্কাশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তৈরি হয় এই জলাবদ্ধতা। এ অবস্থায় অনেকে লাগেজ হাতে, পায়ে হেঁটেই এগিয়েছেন। আবার সড়কের পাশে গর্ত থাকায় বিপাকে পড়তে হয় যাত্রীদের। জলাবদ্ধতার কারণে সময়মতো টার্মিনালে পৌঁছাতে না পারায় অনেককে ফ্লাইট মিস করতেও দেখা যায়। অনেক যাত্রী বাধ্য হয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায় মোটরসাইকেলে চড়ে পানি পাড়ি দিয়েছেন।

ডমেস্টিক ফ্লাইটের এক যাত্রী শাহাব শাবাব রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে হাসিনা পালাল, স্বৈরাচারের বিদায় হলো; তবু গেল না এই জলাবদ্ধতা। একটু বৃষ্টি হলেই সড়ক ডুবে যায়। গাড়ি না কিনে এখন স্পিডবোট কিনতে হবে।’

এদিকে সাধারণ মানুষের যখন এই অবস্থা, তখন বেকায়দায় পড়তে হয় যানবাহনকেও—বিশেষ করে সিএনজি অটোগুলোকে। জলাবদ্ধতার কারণে ইঞ্জিনে পানি ঢুকে অনেক প্রাইভেট কার এবং সিএনজিচালিত অটোরিকশা সড়কে বিকল হতে দেখা যায়। ফলে সেই সব এলাকায় সৃষ্ট হয় দীর্ঘ যানজট।

রাজধানীর রাজাবাজার, নাখালপাড়া, মিরপুরের কালশী ও সিরামিক সড়ক, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি ২৭ সিগন্যালে নষ্ট হয়ে থেমে থাকা যানবাহনের কারণে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খেতে দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের। দুপুর পৌনে ১২টার দিকে পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের মিরপুর বিভাগ নিজেদের ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে ট্রাফিক এলার্ট প্রকাশ করে। আবার বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট যানজটে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা ছিল চাহিদার তুলনায় খুবই নগণ্য। এতে নানান কাজে ঘর থেকে বের হওয়া নগরবাসীকে পোহাতে হয় বাড়তি বিড়ম্বনা।

রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজেদের নানান পদক্ষেপের কথা জানিয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। গুলশানের নগর ভবনে জলাবদ্ধতা নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএনসিসির বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন এর প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ।

তিনি জানান, জলাবদ্ধতাপ্রবণ স্থান চিহ্নিতকরণ, ম্যাপিং, হটস্পট চিহ্নিতকরণসহ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ১০টি অঞ্চলে ২০টি ‘কুইক রেসপন্স টিম’ গঠন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে নিয়মিত পিট, ক্যাচ পিট, ড্রেনেজ লাইন পরিষ্কার করা হচ্ছে। ফলে জলাবদ্ধতা দ্রুত কমছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ২২১ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার স্ট্রম ওয়াটার ড্রেন এবং প্রায় দেড় কিলোমিটার বক্স কালভার্ট পরিষ্কার করা হয়েছে। একই সময়ে প্রায় ১১১ কিলোমিটার রাস্তা এবং ১০৬ কিলোমিটার নর্দমা নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আটটি পদক্ষেপের কথা জানান ডিএনসিসি প্রশাসক।

অন্যদিকে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর/যান্ত্রিক) ড. মোহাম্মদ সফিউল্লাহ সিদ্দিক ভুঁইয়া রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বৃষ্টির সময় দ্রুত পাম্প করা, ড্রেনেজ-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেন পানি দ্রুত সরানো যায় তার জন্য নিয়মিত কাজগুলো করা হয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা দক্ষিণের পুরো পানি সরানো হয় তিনটি পয়েন্টে—কমলাপুর, হাতিরঝিল ও ধোলাইখালে, যা অপ্রতুল।

এজন্য আরও ১০টি আউটপুট তৈরি করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে তিনটি নদীতে (বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও বালু) পানি সরানো হবে। আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি কাজ হচ্ছে, যার মাধ্যমে নিউমার্কেট, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেট এবং শিক্ষা বোর্ড এলাকায় জলাবদ্ধতার নিরসন হবে। বিডিআর বিদ্রোহের আগে এসব এলাকার পানি পিলখানার ভেতরকার সিস্টেম দিয়ে বের হয়ে যেত।

বিদ্রোহের পর সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সেই নেটওয়ার্ক আবার সচলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনটি প্রকল্পের আওতায় পরিবেশ সার্কেল থেকে শিগগির এ বিষয়ে দরপত্র সম্পন্ন করে কাজ শুরু হবে। আশা করা যাচ্ছে, আগামী বছরের শুরুতেই (বর্ষার আগে) কাজ শেষ হবে এবং এটা হলে জলাবদ্ধতার একটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে।’

নগর কর্তৃপক্ষ যা-ই বলুক না কেন, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে জলবাদ্ধতার স্থায়ী সমাধান আর নেই, বরং বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হবে। কত দ্রুত পানি সরানো যায়, সেদিকে মনযোগী হতে হবে সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, “অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে নগরের ‘বেসিক গ্রামার’ নষ্ট হয়েছে। কৃত্রিমভাবে সাময়িকভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে, কিন্তু ড্রেনেজ ও প্রাকৃতিক সমাধানগুলো নষ্ট হয়েছে। যেমন খালগুলো দখল হয়ে যাওয়ায়, পানি সরে যাওয়ার প্রাকৃতিক উপায় আর নেই। আবার কংক্রিটের কারণে পানি ভূগর্ভে যেতে পারছে না। বৃষ্টির অর্ধেক পানি ভূগর্ভে চলে যাওয়ার কথা। এগুলো আর ঠিক করা যাবে না। তাই বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হবে এটা মেনে জলাবদ্ধতাকে নিত্যদিনের সঙ্গী মানতে হবে। এর মাঝেই বিদ্যমান সমাধান যা আছে, সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কীভাবে দ্রুততম সময়ে পানি অপসারণ করা যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে সংশ্লিষ্টদের। যে যা-ই বলুক না কেন, এই শহরে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হবে।’