২০২৪ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মেমফিসে ৪১ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়ন্ত বিমান থেকে লাফ দেন চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। বাংলাদেশের পতাকা হাতে নিয়ে তার ওই স্কাইডাইভ গিনেস বুকে বিশ্ব রেকর্ডের স্বীকৃতি পায় গত বছরের ১ জুলাই। এর কয়েক মাস পর গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর চৌধুরী আশিক বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান। দায়িত্ব গ্রহণের পর বিনিয়োগ বিষয়ে একের পরে এক প্রচারণামূলক কর্মকা-ে উদ্যোগী হন তিনি। বিনিয়োগ আকর্ষণে ইনভেস্টমেন্ট সামিট, স্যাটেলাইট-ভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা পেতে ইলন মাস্কের স্টারলিংকের নিবন্ধন, শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক মহাকাশ অনুসন্ধানে নাসার সঙ্গে চুক্তি, সব বিনিয়োগ প্রচারণা সংস্থাকে একই ছাদের নিচে নিয়ে আসা বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। দায়িত্ব গ্রহণের আজ এক বছর পূর্ণ করেছেন বিনিয়োগের কান্ডারি চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন। তিনি স্বপ্ন দেখেন, ৩০ বছর পর মহেশখালী ও মাতারবাড়ী হবে ‘সিঙ্গাপুর ও সাংহাইয়ের’ মত শহর।
এবার দেখা যাক গত এক বছরে দেশে কেমন বিনিয়োগ বেড়েছে। গত বছরের রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিবর্তনের পর অভ্যন্তরীণ নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশে নিট এফডিআই প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৮৬৪ দশমিক ৬৩ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪ সালের একই সময়ের তুলনায় ১১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। ওই সময়ে বিনিয়োগ ছিল ৪০৩ দশমিক ৪৪ মিলিয়ন ডলার। এই বিনিয়োগ প্রবাহ ২০২৪ সালের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকের তুলনায়ও ৭৬ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি। তখন নিট এফডিআই ছিল ৪৯০ দশমিক ৪০ মিলিয়ন ডলার। ইকুইটি ইনভেস্টমেন্ট বা মূলধনী বিনিয়োগেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে । ২০২৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এটি দাঁড়ায় ৩০৪ দশমিক ৩৮ মিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৮৮ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনার প্রতি আন্তর্জাতিক মহলের ‘আস্থার প্রতীক’। যদিও দেশ এখনো মুদ্রা অস্থিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে।
জানা যায়, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দেশে প্রত্যক্ষ বা সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ৩২টি সংস্কার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), যার ১৮টি এরই মধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে। আরও ছয়টি চলমান রয়েছে। তবে এখনো খুব একটা এগোয়নি ‘এফডিআই ইনসেন্টিভ স্কিম’-এর কার্যক্রম।
বিডার তথ্য অনুযায়ী, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে এরই মধ্যে বাস্তবায়িত ১৮টি সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে জাতীয় এফডিআই স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পাইপলাইন, জাতীয় বন্দর স্ট্র্যাটেজি, ন্যাশনাল সিংগেল উইন্ডো এবং অথরাইসড ইকনোমিক অপারেটর, সার্ভিস পারফরমার ড্যাশবোর্ড, অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যকারিতা ইত্যাদি।
সেটিং আপ স্পেশালাইজড জোন, ইন্টিগ্রেশন উইথ গভর্নমেন্ট ও ক্যাপিটাল রিপ্যাট্রিয়েশন রুলসসহ ছয়টি উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তবে এনার্জি সাপ্লাই স্ট্র্যাটেজি, এফডিআই ইনসেন্টিভ স্কিম, ওয়ার্ক পারমিট অ্যান্ড ভিসা ইস্যুয়িং, টেকসই করনীতিসহ সাতটি উদ্যোগে খুব একটা অগ্রগতি নেই।
বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, সরকারি ও বেসরকারি খাতে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ এখনো প্রত্যাশার তুলনায় কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, এই সমস্যার দ্রুত সমাধান খুবই কঠিন। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, উচ্চ প্রভাবসম্পন্ন বিনিয়োগ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন, ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের সমস্যার সমাধান এবং বড় বিনিয়োগের একটি শক্তিশালী পাইপলাইন তৈরি করাÑ এই চার প্রধান অগ্রাধিকারের ওপর জোর দিচ্ছে বিডা ও বেজা।
জানা গেছে, গত ৭ থেকে ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বিনিয়োগ সম্মেলনে ৫০টি দেশের ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নেন এবং এতে প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে।
বিডা তাদের ওয়ান-স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) পোর্টালেরও হালনাগাদ সংস্করণ চালু করেছে, যার উদ্দেশ্য হলো দেশি ও বিদেশি উভয় বিনিয়োগকারীদের জন্য সেবার গুণমান বৃদ্ধি। এই ওএসএস পোর্টাল ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চালু করা হয় এবং বর্তমানে ৩৫টি সরকারি সংস্থা, ১২টি ব্যাংক ও ৫টি চেম্বার সংস্থার ১৩৩টি সেবা একত্রে প্রদান করে।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও কর্মীদের জন্য নিরাপত্তা ছাড়পত্র (সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স) প্রাপ্তির প্রক্রিয়া এখন থেকে পুরোপুরি ডিজিটাল করার উদ্যোগ নিয়েছে বিডা। গত মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃসংস্থা বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনি, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর (ডিআইপি), আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং বিভিন্ন বিনিয়োগ উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধিরা বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জানানো হয়, নিরাপত্তা ছাড়পত্রের জন্য প্রয়োজনীয় নথি যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে, যাতে তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকে। নির্ধারিত নথি জমা দেওয়ার পরও ২১ কর্মদিবসের মধ্যে যাচাই শেষ না হলে আবেদনটি ‘নিরাপত্তা আপত্তি নেই’ হিসেবে গণ্য হবে এবং সংশ্লিষ্ট ভিসার মেয়াদ স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়বে।
এ ছাড়া, বিদেশি কর্মী ও বিনিয়োগকারীদের ভিসা নবায়ন এবং ভিসা ফি প্রদানের প্রক্রিয়াও ডিজিটাল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ফলে এসব সেবার জন্য আর সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে না। শিগগিরই নতুন বিনিয়োগবান্ধব ভিসা-নীতি চালুর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে। এর আওতায় ভিসা অন অ্যারাইভাল ফি অনলাইনে পরিশোধ করা যাবে। পাশাপাশি একটি আন্তঃসংস্থাগত ইন্টার-অপারেবল তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে, যা বিদেশিদের আগমন ও অবস্থান পর্যবেক্ষণ এবং সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আরও জোরদার করবে।
বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, নিরাপত্তা ছাড়পত্র ডিজিটাল হওয়া একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এতে বিনিয়োগকারীদের জন্য স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে। সীমিত সময়ের মধ্যে আরও কিছু সংস্কার বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে, আশা করছি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই কর্মানুমতি ও ভিসা-সংক্রান্ত বেশ কিছু সংস্কার কার্যকর করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যেমন বিডা নিয়মিত সমন্বয় সভা করে, তেমনি নিরাপত্তা ছাড়পত্র ও কর্মানুমতি-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গেও এখন থেকে মাসিক সভা করা হবে, যাতে গুরুত্বপূর্ণ সেবায় কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন