বাংলা কবিতার ইতিহাসে প্রেম, রোমান্স ও অনুভূতির মূলে যে ধারাটি প্রবাহিত হয়ে এসেছে, তার মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বহুমাত্রিক রোমান্টিকতা কিংবা জীবনানন্দ দাসের অন্তর্মুখী নিঃসঙ্গতার পরে সুনীলের কবিতায় যে প্রেম ও রোমান্স ধরা দেয়, তা একাধারে আধুনিক, শহুরে, ব্যক্তিগত এবং একইসঙ্গে সর্বজনীন। সুনীলের কবিতায় আমরা এক নতুন প্রজন্মের হৃদয়ের কথা শুনি-যেখানে প্রেম শুধু আকাশ-তারার উপমায় বাঁধা নয়, বরং টেলিফোনের তার, ট্রামের লাইন, কফি হাউস কিংবা রাস্তা-ঘাটের ভিড়েও খুঁজে পাওয়া যায়। এদিক থেকেই তার কবিতা রোমান্টিক সুরের আধুনিক রূপকে উপস্থাপন করে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা সাহিত্য মঞ্চে প্রবেশ করেন। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে সমাজে যেমন বিভ্রান্তি, দ্বন্দ্ব, হতাশা ও নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটছিল, তেমনি তরুণ প্রজন্মের মনে প্রেমও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হচ্ছিল। প্রথাগত প্রেমের ধারণা বদলাচ্ছিল, শহরের নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছিল ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সুনীল তার কবিতায় সেই পরিবর্তিত প্রেমের স্বরূপকে ধরতে সক্ষম হন। তার কবিতায় প্রেম একদিকে আবেগঘন, অন্যদিকে বাস্তবতার কঠিন পরশমাখা। তিনি প্রেমকে শুধু চিরন্তন সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে দেখেননি; বরং প্রেমিক-প্রেমিকার মান-অভিমান, বিচ্ছেদ, দৈনন্দিন জীবনের যন্ত্রণা ও আকাক্সক্ষাকে তুলে ধরেছেন।
রোমান্টিকতার মূল সুর হলো অনুভূতির তীব্র প্রকাশ। কিন্তু আধুনিকতার পরিসরে সেই রোমান্টিকতাকে নতুন ভাষা, নতুন প্রতীক ও নতুন প্রেক্ষাপটে প্রকাশ করতে হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতায় আমরা সেই নতুন ভাষা পাই। তিনি প্রেমকে শুধু ফুল-পাহাড়-চাঁদে সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং সিগারেটের ধোঁয়া, হেডলাইটের আলো, মেট্রোরেল কিংবা রাস্তা-ঘাটের কোলাহলের মধ্যেও প্রেমের সুর খুঁজে পান। এভাবে তিনি দেখিয়েছেন, প্রেম আসলে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যা সময়-সমাজ-প্রেক্ষাপটের সঙ্গে পাল্টে যায়, কিন্তু মানুষের হৃদয়ের গভীর আকাক্সক্ষা হিসেবে চিরস্থায়ী থাকে।
সুনীলের কবিতায় প্রেম এক বহুরূপী চরিত্র। কখনো তা কিশোরসুলভ উচ্ছ্বাসে ভরা, কখনো আবার পরিণত বেদনার গভীরতায় নিমগ্ন। তার কবিতায় প্রেম একদিকে আত্মঘনিষ্ঠ, অন্যদিকে সামাজিক বাস্তবতায় ভর করে দাঁড়ায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তার কবিতায় প্রেমিকা কখনো কলেজপড়ুয়া তরুণী, কখনো নিঃসঙ্গ শহুরে নারী, আবার কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনের মিছিলে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রতিবাদী মুখ। এই বহুমাত্রিক প্রেমের প্রকাশই সুনীলকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।
প্রেমিক সত্তার পাশাপাশি সুনীলের কবিতায় প্রেমিকা এক স্বাধীনসত্তা হিসেবে উদ্ভাসিত। আগেকার কবিতায় প্রেমিকা অনেক সময় কেবল রূপসী, দূরবর্তী বা কল্পনার জগতে আবদ্ধ থাকত। কিন্তু সুনীলের কবিতায় তিনি সমসাময়িক, শহুরে, বাস্তব এবং সক্রিয়। তার হাসি, অভিমান, রাগ কিংবা অনুপস্থিতি কবির মানসজগতকে আলোড়িত করে। সুনীল তাই প্রেমিকাকে দেবীর আসন থেকে নামিয়ে এনে জীবনের প্রতিদিনের রাস্তায় দাঁড় করান, যেখানে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক আর কেবল আদর্শিক নয়, বরং গভীরভাবে মানবিক।
এই রোমান্টিক সুরের আধুনিক রূপ ফুটে ওঠে তার কবিতার ভাষায়ও। সুনীলের কবিতা সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ও চলিতভাষার স্বাদে ভরা। তিনি আড়ষ্ট অলঙ্কার ব্যবহার করেননি; বরং কথোপকথনের ভঙ্গিমায় প্রেমের আবেগ প্রকাশ করেছেন। এ কারণে পাঠক মনে করেন, কবিতাটি যেন তার নিজের হৃদয়ের কথাই বলছে। প্রেমের আবেগ তাই হয়ে ওঠে ব্যক্তিগত, অথচ সর্বজনীন। আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক এই সরল অথচ গভীর প্রকাশে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
সুনীলের কবিতায় রোমান্টিকতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গতা। আধুনিক নগরজীবন যেমন- মানুষের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে, তেমনি প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্কেও অস্বস্তি ও অনিশ্চয়তার ছাপ পড়েছে। সুনীল নিখুঁতভাবে সেই মানসিক দ্বন্দ্বকে কবিতায় তুলে ধরেন। প্রেমের পাশাপাশি হারিয়ে ফেলার ভয়, বিচ্ছেদের দুঃখ এবং পুনর্মিলনের আকাক্সক্ষা তার কবিতায় বারবার প্রতিফলিত হয়। এভাবেই তার কবিতায় রোমান্টিক সুর কোনো মায়াবি স্বপ্ন নয়, বরং বাস্তবের সঙ্গে যুক্ত এক গভীর মানসিক অভিজ্ঞতা। তার কবিতায় আমরা দেখি, প্রেম কখনো আলো, কখনো অন্ধকার। প্রেমিক-প্রেমিকার মিলনে যেমন অনাবিল আনন্দ, তেমনি বিচ্ছেদে প্রবল বেদনা। সুনীল এই দুই বিপরীত অনুভূতিকেই কবিতায় সমানভাবে স্থান দিয়েছেন। প্রেম শুধু সুখের নয়, তা দুঃখেরও। প্রেম শুধু উল্লাসের নয়, তা শূন্যতারও। এই দ্বান্দ্বিক দিকটি তার কবিতাকে আধুনিকতার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।
সুনীলের কবিতায় প্রেমকে সময় ও সমাজের পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। তিনি জানতেন, আধুনিক মানুষ শুধু নিভৃতে বসে প্রেম করতে পারে না; তাকে মেট্রোরেল ধরতে হয়, অফিসের চাপ সামলাতে হয়, রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশ নিতে হয়। অথচ এই ব্যস্ততার মাঝেও প্রেম বেঁচে থাকে, তার প্রকাশ ঘটে। ফলে সুনীলের কবিতায় প্রেমিক-প্রেমিকা শহরের অলিতে-গলিতে হাটে, বাসে-ট্রামে বসে কথা বলে, কিংবা আন্দোলনের মাঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরে। এই দৃশ্যপট বাংলা কবিতায় নতুনত্ব আনে। তার কবিতার প্রেম তাই একদিকে স্বপ্নময়, অন্যদিকে বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড়ানো। এই দুই মেরুর টানাপোড়েনে তার রোমান্টিক কবিতা আধুনিকতা অর্জন করেছে। পাঠক তার কবিতা পড়তে গিয়ে বুঝতে পারেন, প্রেম কোনো অলীক কল্পনা নয়; তা জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো- সুনীল তার কবিতায় প্রেমকে শুধু ব্যক্তিগত আবেগ হিসেবে দেখেননি, বরং তাকে সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটেও যুক্ত করেছেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক অস্থিরতা, নকশাল আন্দোলন, যুব সমাজের বিভ্রান্তি- এসব তার কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে। প্রেম সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পর্ক অনেক সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ফলে সুনীলের কবিতার প্রেম কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং প্রজন্মের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।
রোমান্টিকতার আধুনিক রূপ হিসেবে তার কবিতার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো সংবেদনশীলতা। তিনি ক্ষুদ্রতম অনুভূতিকে ধরতে পারতেন। একটি ফোন না আসা, হঠাৎ করেই কাউকে না পাওয়া, অথবা বৃষ্টির ভেজা রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে থাকা- এসব মুহূর্তকে তিনি কবিতায় অমর করে তুলেছেন। এই সংবেদনশীলতা আধুনিক মানুষের প্রেমের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে যায়। পাঠক মনে করেন, এ যেন তার নিজের জীবনেরই কথা।
সুনীলের কবিতার রোমান্টিকতা শুধু প্রেমে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রকৃতির সঙ্গেও যুক্ত। তবে তার প্রকৃতি কেবল জীবনানন্দীয় অরণ্যের নিঃসঙ্গতা নয়; বরং শহরের বাগান, রাতের আলো-অন্ধকার কিংবা জানালার ধারে বসে দেখা আকাশ। এই প্রকৃতিও আধুনিক মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ধরা পড়ে। প্রকৃতি আর দূরের নয়; বরং প্রেমের আবেগের মধ্য দিয়ে তা জীবনের অংশ হয়ে ওঠে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা প্রমাণ করেছে যে প্রেম চিরন্তন, কিন্তু তার রূপ ও প্রকাশ সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায়। রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দ যে প্রেমকে এক ধরনের আধ্যাত্মিকতা বা নিঃসঙ্গতায় খুঁজে পেয়েছিলেন, সুনীল সেই প্রেমকে আধুনিক শহরের বাস্তবতায় ফিরিয়ে এনেছেন। তার কবিতা তাই একদিকে রোমান্টিক, অন্যদিকে সমসাময়িক।
বাংলা কবিতার পাঠকের কাছে সুনীলের রোমান্টিক কবিতা এক বিশেষ আকর্ষণ হয়ে আছে। কারণ তার কবিতায় পাঠক নিজের প্রেমের গল্প খুঁজে পান। আধুনিক শহুরে জীবনের চাপ, নিঃসঙ্গতা, দুঃখ, উল্লাস- সবই সেখানে প্রতিফলিত। প্রেম এখানে আর দূরের নয়, বরং হাতের নাগালের। এই কারণেই তার কবিতা প্রজন্মের পর প্রজন্মকে টেনেছে।
সবশেষে বলা যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা রোমান্টিক সুরকে নতুন প্রজন্মের জন্য নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তিনি দেখিয়েছেন, প্রেম কেবল কাব্যিক অলংকার নয়, বরং জীবনের অবিচ্ছেদ্য অভিজ্ঞতা। তার কবিতায় প্রেম বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণে এক অনন্য রূপ পেয়েছে, যা আধুনিকতার সঙ্গে সমান্তরালে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বলা যায়- সুনীলের কবিতা হলো রোমান্টিক সুরের আধুনিক রূপ, যেখানে প্রেমের আবেগ, নিঃসঙ্গতা, বাস্তবতা ও স্বপ্ন একাকার হয়ে যায়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন