* ছাত্রলীগের ছদ্মবেশে সাংগঠনিক দুর্বলতায় ক্ষোভ ত্যাগীদের
* ঢাবিতে গণেশ চন্দ্র ও সম্পাদক শিপনের নেতৃত্বে ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ
* ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরসহ ২ হাজারের বেশি অনুপ্রবেশ
* বেশি অনুপ্রবেশ ঢাবি, জাবি, তিতুমীর ও ঢাকা কলেজে
ভোল পালটে সারা দেশের ছাত্রদলের কমিটিতে ঢুকে পড়ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা ছদ্মবেশ ধারণ করে ছাত্রদলের ছাতায় আশ্রয় নেওয়ায় সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক দুর্বলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ নিয়ে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সম্প্রতি তিনি এসব বিষয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এবং ত্যাগী নেতাকর্মীদের মূল্যায়নের কথা চিন্তা করেছেন বলে একাধিক সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছেন।
ছাত্রদলে ছাত্রলীগের অনুপ্রবেশের বিষয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক ত্যাগী নেতাকর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে রূপালী বাংলাদেশকে বলেছেন, ছাত্রলীগ পুনর্বাসনের দায়িত্ব কি বর্তমান কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়েছেন? এ দায়িত্ব তাদের কে দিয়েছে? তাদের দাবি, ছাত্রদলকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করতেই ডাকসুতে ভরাডুবি করা হয়েছে। ছাত্রদলকে বিতর্কিত করতে কৌশলে কাজ করছে অনুপ্রবেশকারীরা। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের আগের ছাত্রদল ও পরের ছাত্রদলের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য চোখে পড়েছে। শেখ হাসিনার আমলে বিরোধীদের দমন-নিপীড়নে ছাত্রদল যেমন কোণঠাসা ছিল, তাতে গণঅভ্যুত্থানের পরপর সাধারণ মানুষের মনে তাদের প্রতি একটা আস্থার জন্ম হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে চাঁদাবাজি ও আধিপত্যের দ্বন্দ্বে সমালোচনার শিকার হয় সংগঠনটি। যার প্রভাব ডাকসু নির্বাচনের ফলাফল।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও দপ্তরের একটি বিশেষ সূত্র জানায়, ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর এ পর্যন্ত গত ১৩ মাসে সারা দেশ থেকে ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য সংগঠনের প্রায় ২ হাজারের বেশি নেতাকর্মী ছাত্রদলের কমিটিতে স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটিতে সরাসরি রয়েছে প্রায় ৮১ জন। তা ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর ৫১ জনের নাম আছে, তারা বিগত সময়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিল। এ ছাড়া অভিযোগ আছে সারা দেশের কলেজ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ জেলা-উপজেলার কমিটিতে টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও দোসররা প্রবেশ করেছে। এদিকে ‘সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ অর্থাৎ সাত কলেজে ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগের নেতার্মীরা গুপ্তভাবেই রয়েছে। তবে এর মধ্যে বেশি ঢাকা কলেজ ও তিতুমীর কলেজ ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ-শিবিরসহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীর প্রবেশ বেশি।
ঢাবিতে গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের নেতৃত্বে ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ:
সূত্রমতে জানা গেছে, গত মাসের ৮ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮টি হলের জন্য নতুন আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রদল। এদিন পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন কমিটি অনুমোদনের কথা জানান। এরপর তারা সমালোচনার মুখে পড়ে। গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের প্রশ্ন করেন, ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ কীভাবে এলো? এমন প্রশ্নের সঠিক জবাব তারা দিতে পারেননি।
সূত্রমতে, নতুন কমিটিতে মোট ৫৯৩ জনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে তাদের মধ্যে কয়েকজনের বিরুদ্ধে ‘তথ্য গোপন রেখে সংগঠনে যোগদান’ এবং ‘সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, নবগঠিত কমিটির কয়েকজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ নিয়ে সংগঠনের ভেতরেই শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। এ প্রেক্ষাপটে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাবি ছাত্রদলের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, ঢাবির নতুন কমিটিতে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কর্মীরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখানে শিবিরও রয়েছে। কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়া কমিটি দেওয়া হয়েছিল, যা নিয়ে ছাত্রদলের অনেক নেতাকর্মীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়, যার প্রভাব ডাকসুতে পড়েছে। কেউ কেউ ফেসবুকে এ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
তিনি অভিযোগ করে আরও বলেন, ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস ও সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপনের নেতৃত্বে ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ ও শিবিরের আখড়া হয়ে উঠেছে। যেটা দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে, ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ ও শিবির থেকে ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রদলকে পরিকল্পিতভাবে ভরাডুবিতে পরিণত করেছে।
জাবি ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ, অছাত্র ও বিতর্কিতদের পদায়ন: দীর্ঘ আট বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর জাবি ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ, অছাত্র ও বিতর্কিতদের পদায়নের অভিযোগ উঠে। অভিযোগ উঠে এ কমিটিতে ছাত্রলীগ ও শিবিরের বেশ কিছু সদস্য ও নেতাকর্মী প্রবেশ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কমিটির এক দায়িত্বশীল যুগ্ম আহ্বায়ক রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের ছাত্রদলের কমিটিতে ছাত্রলীগ ও শিবির মাইন্ড নেতাকর্মীর সংখ্যা বেশি। তা ছাড়া অনেক ত্যাগীরা কমিটিতে বাদ পড়েছে এবং যোগ্য জায়গায় আসেনি। যার কারণে দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন, শুধু জবি নয়, ঢাবিসহ দেশের সব জায়গার কমিটিতে ছাত্রলীগ ও শিবির প্রবেশ করে ছাত্রদলকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হচ্ছে। আরেক নেতা বলেন, অভিযোগ উঠেছে নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিতে অছাত্র ও বিতর্কিতদের নেওয়া হয়েছে। আগে ছাত্রলীগ করেছেন এমন অনেকেই পেয়েছেন দায়িত্বশীল পদ। এ ছাড়া দলীয় কোনো প্রোগ্রামে উপস্থিত না হয়ে ও জীবনবৃত্তান্ত জমা না দিয়েও পদ পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব জানান, আপাতত এ বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না। তবে কয়েক দিন পর সার্বিক বিষয়ে কথা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন জানান, একটি মিটিংয়ে আছি, আপনার কথা তেমন বোঝা যাচ্ছে না। পরে কল দিতে চাইলেও তিনি আর কলব্যাক করেননি।
ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস রূপালী বাংলাদেশকে জানান, একটি বৈঠকে আছি। পরে কথা হবে। প্রশ্নটি লিখে দিয়েছি আশা করি উত্তর দেবেনÑ এমন প্রশ্নের জবাবেও তিনি সাড়া দেননি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভাপতি প্রার্থী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে গড়া সংগঠন। এতে ছাত্রলীগ-শিবির নেতাদের পদায়ন মেনে নেওয়া যায় না। ছাত্রলীগ নেতাদের পদায়নে ও অপ্রস্তুত অবস্থার পাশাপাশি পুরো জামায়াতি প্রশাসন, ওএমআর পদ্ধতিতে ভোট গণনা, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ার ডাকসু নির্বাচনে যারা নিয়ে গিয়েছে তাদের চিহ্নিত করার পাশাপাশি সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির এক সহসভাপতি রূপালী বাংলাদেশকে আক্ষেপ করে জানান, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আরও ১০ বছরের দায়িত্ব দেওয়া হোক। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশোনাও করবে এবং রাজনীতিও করবেন। তাহলেই ফের ডাকসুর নির্বাচনে ছাত্রদল বিজয়ী হবে।
যদিও এর আগে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির দায়িত্ব নিয়ে বলেছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন হলে প্রকাশ করা ছাত্রদলের কমিটিতে অর্ধশতাধিকের বেশি ছাত্রলীগ নেতাকর্মী রয়েছে। তা ছাড়া সারা দেশে তাদের কমিটিতে বিভিন্ন ধরনের লোকজন আছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘সম্প্রতি ছাত্রদল যে কমিটি প্রকাশ করেছে; আমাদের প্রাপ্ত তথ্যমতে, সেখানে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কমিটিতে ছিল, তাদের নাম রয়েছে। মানুষ তো এসব অবজার্ভ (পর্যবেক্ষণ) করছে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন