সোমবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রঙের মানুষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১১:২৮ পিএম

অচিন দেশে লালনকন্যা

রঙের মানুষ প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২৫, ১১:২৮ পিএম

অচিন দেশে লালনকন্যা

‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে’, ‘বাড়ির কাছে আরশিনগর’, ‘নারী আমার জানে দুঃখের ভাষা’, ‘ভ্রমর কইও গিয়া’ প্রভৃতি গান দিয়ে মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেওয়া লালনসংগীতের বরেণ্য শিল্পী ফরিদা পারভীন। অবশেষে জীবন যুদ্ধে হেরেই গেলেন। জাগতিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তিনি পাড়ি দিয়েছেন অচিন দেশে। গত শনিবার রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য গতকাল সকালে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নেওয়া হয় দেশবরেণ্য এ শিল্পীর মরদেহ। পরে রাতে কুষ্টিয়ায় মা-বাবার কবরে তাকে দাফন করা হয়। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাঁচার জন্য লড়েছিলেন বাউল সংগীতের কিংবদন্তি ও একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী ফরিদা পারভীন।

২০১৯ সালে কিডনি রোগে আক্রান্ত হন গুণী এই সংগীতশিল্পী। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে শ্বাসকষ্টজনিত কারণে রাজধানীর একটি হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। ৭১ বছর বয়সি এই শিল্পী শুধু কিডনি সমস্যা নয়, ডায়াবেটিসসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলন দীর্ঘদিন ধরে।

পুরো জীবনটাই সংগীতের সঙ্গে কেটেছে কিংবদন্তি এই শিল্পীর। অসুস্থ হওয়ার কয়েক মাস আগে এক সাক্ষাৎকারে ফরিদা পারভীন বলেছিলেন, ‘গানের জন্য আরেকটু বাঁচতে ইচ্ছে করে। আরও কিছু সংগীতের জন্য ভালো করার ইচ্ছা জাগে। তারপরও মানুষ তো মরণশীল। দুনিয়ার জীবন অস্থায়ী।’

বাংলার বাউল গানের সঙ্গে সুফিজম ও সহজিয়া বৈষ্ণব মতের দারুণ সম্পর্ক রয়েছে। লালন শাহের যে গান তাতে সুফিজমের বিশাল প্রভাব দেখা যায়। মানবতাবাদী এ সাধক তার গানে ধর্ম, বর্ণ, গোত্রসহ সব জাতিগত বিভেদ ভুলে মানবতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। একটা সময় পর্যন্ত এ দেশে লালনের গান বিভিন্ন বাউল আসরে গাওয়া হতো। ‘ভদ্র সমাজে’ কাউকে গাইতে দেখা যেত না। মহাত্মা এ সাধকের গানকে যিনি সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি ফরিদা পারভীন।

প্রখ্যাত এ শিল্পী ছোটবেলা থেকেই এক সংস্কৃতিমনা পরিবারে বড় হয়েছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের প্রথম অনুপ্রেরণা সংগীত।’ তিনি বিশ্বাস করতেন সংগীতের মাধ্যমে জীবনের গভীর অর্থ উপলব্ধি করা যায়। তার মতে, সংগীত শুধু একটি পেশা নয়, এটি জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি তার সংগীত ক্যারিয়ারের মধ্যে যে সাদৃশ্য এবং আত্মার শান্তি খুঁজে পেয়েছেন, তা পরবর্তীতে তার দর্শন এবং গানের সুরে প্রকাশ পায়।

ছোটবেলা মায়ের সুরেলা কণ্ঠে গান শুনতেন আর তার পাশে বসে হারোমোনিয়াম বাজাতেন। বলা যায়, ওখান থেকেই তার সুর সাধনা শুরু। বিখ্যাত সব মানুষদের কাছ থেকে গানের তালিম নিয়েছেন।

বুকের মধ্যে লালনের দর্শনকে ধারণ করার কারণে অনেকে ভাবত তিনি অন্য কোনো শিল্পীর গান শুনেন না বা পছন্দ করেন না। এক সাক্ষাৎকারে ফরিদা পারভীন জানিয়েছিলেন, শৈশবকাল থেকেই সন্দ্বীপা মুখোপাধ্যায়ের মধুর কণ্ঠস্বর তাকে অনেক মুগ্ধ করেছে। তার গান নিয়ে ফরিদা পারভীন বলেছিলেন, ‘তার গানে একটি বিশেষ আবেগ ছিল, যা আমার মনকে ছুঁয়ে গিয়েছিল।’ তা ছাড়া তিনি পিন্টু ভট্টাচার্য, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, জগন্নাথ মিত্র এবং যতীলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের গানও অনেক পছন্দ করতেন। দেশীয় শিল্পীদের মধ্যে নিলুফার ইয়াসমিন, ফেরদৌসি রহমান, শাহনাজ রহমানতুল্লাহ এবং সুবীর নন্দী তার প্রিয় শিল্পী ছিলেন। প্রিয়াঙ্কা গোপে, বিজন মিস্ত্রি-এর গানও তিনি উপভোগ করতেন বলে জানিয়েছিলেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর নাটোর জেলার সিংড়া থানার শাঔঁল গ্রামে ফরিদা পারভীনের জন্ম। তার প্রাতিষ্ঠানিক স্কুল জীবন কেটেছে বিভিন্ন শহরে। স্কুল জীবনের সূচনা হয়েছিল মাগুরায়।

গানের শিক্ষা জীবনেরও হাতেখড়ি মাগুরা জেলায়। মাগুরায় তার গানে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন ওস্তাদ কমল চক্রবর্তী। পরবর্তীতে তিনি কুষ্টিয়ার তখনকার গানের ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণির কাছে ক্ল্যাসিক্যাল শেখেন। প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরার সঙ্গে ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা করার পর তিনি নজরুলসংগীত শিখতে শুরু করেন। তার নজরুলসংগীতের প্রথম গুরু হচ্ছেন- কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদের। এরপর তিনি মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলীর কাছেও নজরুলসংগীত শেখেন। স্বরলিপি দিয়ে নজরুলের গান হারমোনিয়ামে ও কণ্ঠে তোলার কাজটি তিনি ওস্তাদ মীর মোজাফফর আলীর কাছেই প্রথম শেখেন।

সংগীত জগতে তার পথচলা শুরু ১৯৬৮ সালে, রাজশাহী বেতারে নজরুলসংগীতের শিল্পী হিসেবে। ১৯৭৩ সালে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন। পরবর্তীতে সাধক মোকসেদ আলী শাহর কাছে তালিম নিয়ে নিজেকে লালনসংগীতের অন্যতম প্রধান কণ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।

ফরিদা পারভীনের কর্মজীবন সংগীতময়। শুধু লালনের গান নয়, তিনি একাধারে গেয়েছেন আধুনিক এবং দেশাত্মবোধক গান। তার গাওয়া আধুনিক, দেশাত্মবোধক কিংবা লালন সাঁইয়ের গান সমানভাবেই জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে ‘এই পদ্মা, এই মেঘনা, এই যমুনা-সুরমা নদীর তটে’, ‘তোমরা ভুলেই গেছ মল্লিকাদির নাম’, ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে প্রেমের কী সাধ আছে বল’, ‘খাঁচার ভেতর’, ‘বাড়ির কাছে আরশি নগর’ ইত্যাদি।

লালনের গান গেয়ে দেশ-বিদেশে খ্যাতি কুড়ানো যেসব শিল্পী আছেন তাদের সবার অগ্রভাগে ফরিদা পারভীন। যিনি ‘লালনকন্যা’ হিসেবেই পরিচিত। তার এই অনন্য কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ সেই ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। ১৯৯৩ সালে অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। জাপানের ‘ফুকুওয়াকা এশিয়ান কালচার’ পুরস্কার লাভ করেন ২০০৮ সালে। এ ছাড়া বহু পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। বিবিসি জরিপে যে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গান নির্বাচিত করেছে তার মধ্যেও আছে ফরিদা পারভীনের কণ্ঠে লালনের গান।

ফরিদা পারভীন লালনের গান নিয়ে কোথায় যাননি, ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর সব প্রান্তে নিয়ে গেছেন। লালনের যে জীবন দর্শন তা শুধু এক সময় বাউলদের মধ্যে চর্চা হতো। কিন্তু এখন কয়েক হাজার মানুষ এ দর্শনে বিশ্বাসী। এটা সম্ভব হয়েছে ফরিদা পারভীনের অনেকটাই একক প্রচেষ্টায়।

লালন উৎসব নিয়মিত করা, লালন একাডেমি প্রতিষ্ঠা, লালনকে ঘিরে তার অনেক অবদান রয়েছে। তরুণদের মধ্যে শুদ্ধ লালন সংগীতচর্চা বাড়াতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশন’। সংগীত শেখার ব্যাপারে তার অভিমত ছিল, ‘কোনো শর্টকার্ট পদ্ধতিতে শিল্পী হওয়া যায় না’।

লালনের গান গেয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া ফরিদা পারভীনের ইচ্ছা ছিল তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এ গানকে আরও বেশি ছড়িয়ে দেওয়ার। এ লক্ষ্যেই ফরিদা পারভীন ফাউন্ডেশন হয়েছে। এটার পরিচালনায় ‘অচিন পাখি’ আছে। দেশবরেণ্য এই শিল্পী গানে গানে কাটিয়েছেন ৫৫ বছর। তবুও জীবনের শেষ সময়ে সুস্থ হয়ে  আরও একবার ফিরতে চেয়েছিলেন গানে। কিন্তু তার আর ফেরা হলো না। অচিন দেশে গুণী এই শিল্পী।


 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!