বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় এক অস্বস্তিকর পরিবর্তন চোখে পড়ছে সম্প্রতি বছরগুলোতে। সেই পরিবর্তনের নাম মব সংস্কৃতি। এক সময় এটি ছিল বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা, কিন্তু এখন এটি সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। মব মানে কেবল কয়েকজন উত্তেজিত মানুষের ভিড় নয়; এটি হলো এক ধরনের মানসিকতা, যেখানে আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা না রেখে তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ বা শাস্তির মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। অথচ এই প্রক্রিয়ায় নিরীহ মানুষও প্রাণ হারাচ্ছে, আবার প্রকৃত অপরাধীরাও আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছে না। সমাজে এভাবে ন্যায়বিচারের বিকল্প হিসেবে মব সংস্কৃতির বিস্তার রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য ভয়ংকর বার্তা বহন করছে।
এই প্রবণতা বিশেষভাবে তীব্র হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়ে পড়েছে। রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে প্রশাসনিক কাঠামো ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো কার্যত দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়েছে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। মানুষকে তারা উসকে দিচ্ছে নানা ইস্যুতে, কখনো ধর্ম অবমাননার অভিযোগে, কখনো রাজনৈতিক প্রতিহিংসায়, আবার কখনো সামান্য সামাজিক বা ব্যক্তিগত বিরোধকে বড় করে দেখিয়ে। মুহূর্তের মধ্যে মানুষ জড়ো হচ্ছে, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, ফলে কোথাও একজন মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, কোথাও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে আগুন লাগানো হচ্ছে।
মব সংস্কৃতির সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হলো ধর্মীয় উগ্রপন্থার সঙ্গে এর মিশ্রণ। রাজবাড়ী জেলায় সম্প্রতি এমনই এক ভয়াবহ ঘটনার সাক্ষী হয়েছে মানুষ। সেখানে নুরাল পাগলা নামক একজন ব্যক্তির লাশ কবর থেকে উঠিয়ে, লাশ পিটিয়ে এবং পুড়িয়ে কয়েকশ মানুষ পৈশাচিক উদযাপন করে, যা এদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এ ধরনের ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন যতই হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে, জনতার উত্তেজনার সামনে তারা প্রায় অসহায় হয়ে পড়ে। আইনের প্রতি অবিশ্বাসই এ ধরনের পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা ব্যবহার করছে চরমপন্থিরা। ধর্মকে ব্যবহার করে তারা জনতার আবেগ উসকে দিচ্ছে। কোনো গুজব ছড়ানো হলো, কেউ নাকি কোরআন অবমাননা করেছে, কেউ ধর্মবিরোধী মন্তব্য করেছে, কিংবা কোনো সংখ্যালঘু সদায়ের সদস্য নাকি ইসলামবিরোধী কাজ করেছে। মুহূর্তেই মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, গ্রামের শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ছে। অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারকে না চিনেই ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে, দোকানপাটে আগুন দেওয়া হচ্ছে, মানুষের ওপর নৃশংস হামলা চালানো হচ্ছে। এই ধরনের ঘটনায় প্রমাণিত হয়, মব সংস্কৃতি এখন কেবল আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতার ফসল নয়, বরং এটি ধর্মীয় আবেগকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
অন্যদিকে, রাজনৈতিক অস্থিরতা মব সংস্কৃতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা কখনো প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য জনতাকে উত্তেজিত করছে, আবার কখনো নিরীহ মানুষকে বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। ফলে মব কেবল একটি স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ প্রকাশ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তা পরিকল্পিতও হয়ে উঠছে। একদিকে প্রশাসনের দুর্বলতা, অন্যদিকে উগ্রপন্থি ও রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের প্ররোচনা- সব মিলিয়ে মব সংস্কৃতি এখন বাংলাদেশে এক ভয়ংকর সামাজিক রোগে পরিণত হয়েছে।
মব সংস্কৃতির শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাদের মেরে ফেলা হয়েছে তারা প্রকৃত অপরাধীই নন। গুজবের শিকার হয়ে তারা জীবন হারিয়েছেন। কোনো চোর সন্দেহে, কোনো নারী অপহরণ করেছে সন্দেহে, কিংবা ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মানুষ মারা গেছেন। পরে তদন্তে দেখা গেছে, তারা নির্দোষ। কিন্তু তাদের জন্য ন্যায়বিচার আর ফিরিয়ে আনা যায়নি। আবার কেউ প্রকৃত অপরাধী হলেও মবের হাতে মারা যাওয়ায় আইনি প্রক্রিয়ায় তার অপরাধ প্রমাণের সুযোগ থাকে না। ফলে আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা আরও ভেঙে পড়ে।
এখানে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে সামাজিক আস্থার। মানুষ একে অপরকে সন্দেহ করতে শুরু করছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। তারা মনে করছে, যেকোনো মুহূর্তে মব তাদের ওপর হামলা চালাতে পারে। এতে দেশ থেকে তাদের বড় একটি অংশ চলে যাওয়ার প্রবণতা তৈরি হতে পারে, যা সামাজিক ভারসাম্যের জন্য ক্ষতিকর। একই সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও আশঙ্কিত হয়ে পড়ছেন। একটি দেশে যদি আইনের শাসন না থাকে, বরং মবের শাসন চলে, সেখানে বিনিয়োগ নিরাপদ নয়।
মব সংস্কৃতি ক্রমেই বাংলাদেশকে একটি সহনশীল সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। এক সময় এই দেশকে বলা হতো বহুত্ববাদী, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও মতের মানুষ মিলেমিশে বসবাস করে। কিন্তু মব সংস্কৃতি সেই সহনশীলতাকে ধ্বংস করছে। আজ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে ধর্মীয় উগ্রতার অজুহাতে, কাল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হচ্ছে মবের হাতে। এমনকি নারীদের পোশাক বা ব্যক্তিগত আচরণকেও এখন মবের রোষের কারণ বানানো হচ্ছে। এর ফলে সমাজে ভয়, আতঙ্ক ও অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।
এই প্রবণতার দীর্ঘমেয়াদি পরিণতি ভয়াবহ। প্রথমত, সামাজিক সম্প্রীতি ভেঙে পড়বে। দ্বিতীয়ত, অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খাবে। বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে, দেশীয় ব্যবসায়ীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। তৃতীয়ত, রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। যখন মানুষ আর আইনের শাসনে বিশ্বাস রাখবে না, তখন অরাজকতা অনিবার্য। এর সুযোগ নেবে উগ্রবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠী। তারা জনতাকে উসকে দিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী পরিবেশ তৈরি করতে চাইবে।
তাহলে সমাধান কী? প্রথমত, আইনের শাসনকে দৃঢ় করতে হবে। বিচারব্যবস্থাকে দ্রুত, কার্যকর ও স্বচ্ছ করতে হবে, যাতে মানুষ ন্যায়বিচার পেতে বিশ্বাস করে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, গুজব প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে হবে, তবে তা যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ না করে। তৃতীয়ত, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শান্তি, সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ প্রচারের কাজে লাগাতে হবে। মসজিদের মাইকে মানুষকে উত্তেজিত না করে বরং শান্তি বজায় রাখতে আহ্বান জানাতে হবে। চতুর্থত, রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়িত্বশীল হতে হবে। মবকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে তা শেষ পর্যন্ত নিজেদের জন্যও বিপদ ডেকে আনবে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- জনসচেতনতা। মানুষকে বোঝাতে হবে যে মবের হাতে বিচার মানে আইনের মৃত্যু। এটি সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য এবং প্রতিটি নাগরিকের জন্য ক্ষতিকর। ধর্ম বা রাজনীতির নামে মব সংস্কৃতিকে বৈধতা দিলে তার শিকার যে কেউ হতে পারে। আজ অন্যকে লক্ষ্য করা হচ্ছে, কাল হয়তো নিজের পরিবারই সেই মবের টার্গেটে পরিণত হবে, হয়তো সেই বীজ প্রথিত হচ্ছে আমাদের সবার দৃষ্টির অগোচরে।
বাংলাদেশ একসময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষতা, মানবিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়েছিল। আজ যদি মব সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উগ্রবাদ সেই শপথকে ভেঙে দেয়, তবে তা হবে জাতির জন্য এক আত্মঘাতী পরিণতি। সময় এখনই যখন রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে দাঁড়াতে হবে। নইলে এই অন্ধকার থেকে আর বেরোনো কঠিন হয়ে যাবে।
শেখ শামীম ইকবাল, কলাম লেখক
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন