- জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার হওয়ার শঙ্কা অপরাধ বিশ্লেষকদের
- লুট হওয়া ৯৪৮ অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার ৭৯৩টি
- ৬,৬৫১টি টিয়ার শেল ও গ্যাস গ্রেনেডের মধ্যে উদ্ধার ৫,৬৩২টি
- লুট হওয়া ৭৯,৮২৪টি কার্তুজ ও গোলাবারুদের মধ্যে উদ্ধার ৬০,৬৬১টি
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) আটটি থানা ও আটটি ফাঁড়িতে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। এ সময় থানা ও ফাঁড়িগুলোতে অগ্নিসংযোগ করাসহ লুট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। বছরজুড়ে নগর পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের পরও ভয়ংকর সেসব মারণাস্ত্র পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেনি সিএমপি।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, গণ-অভ্যুত্থানে সিএমপির থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ছিল ৯৪৮টি, টিয়ার গ্যাস শেল ও গ্যাস গ্রেনেড ৬ হাজার ৬৫১টি, কার্তুজ ও গোলাবারুদ ৭৯ হাজার ৮২৪টি। সিএমপির তথ্যভা-ার বলছে, লুট হওয়া ৯৪৮টি অস্ত্রের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৭৯৩টি। ১৫৫টি মারণাস্ত্রের এখনো কোনো সন্ধান পায়নি পুলিশ। খোয়া যাওয়া ৬ হাজার ৬৫১টি টিয়ার গ্যাস শেল ও গ্যাস গ্রেনেডের মধ্যে পুলিশ উদ্ধার করেছে ৫ হাজার ৬৩২টি। ১ হাজার ১৯টি টিয়ার গ্যাস শেল ও গ্যাস গ্রেনেডের হদিস পাচ্ছে না পুলিশ। লুট হওয়া ৭৯ হাজার ৮২৪টি কার্তুজ ও গোলাবারুদের মধ্যে পুলিশ এ পর্যন্ত উদ্ধার করেছে ৬০ হাজার ৬৬১টি। এখনো উদ্ধার হয়নি ১৯ হাজার ১৬৩টি কার্তুজ ও গোলাবারুদ।
সিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী লুট হওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ ৭.৬২ মিমি রাইফেল (চায়না) ১০৫টি, ৭.৬২ মিমি এসএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৬২টি, ৭.৬২ মিমি এলএমজি-টি (চায়না) ১টি, ৭.৬২ মিমি পিস্তল-টি ৫৪ (চায়না) ৪৫টি, ৯ মিমি পিস্তল ১১০টি, ৯ মিমি এসএমজি/এসএমটি ৩টি, ১২ বোর শটগান ৪১৪টি, ৩৮ মিমি গ্যাসগান (সিঙ্গেল শট) ২০৩টি, ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার (সিক্স শট) ৫টি। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৭.৬২ মিমি রাইফেল (চায়না) ৮৭টি, ৭.৬২ মিমি এসএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৫৪টি, ৭.৬২ মিমি এলএমজি-টি (চায়না) ১টি, ৭.৬২ মিমি পিস্তল-টি ৫৪ (চায়না) ২৯টি, ৯ মিমি পিস্তল ৬৮টি, ৯ মিমি. এসএমজি/এসএমটি ৩টি, ১২ বোর শটগান ৩৫৯টি, ৩৮ মিমি গ্যাসগান (সিঙ্গেল শট) ১৮৯টি, ৩৮ মিমি টিয়ার গ্যাস লঞ্চার (সিক্স শট) ৩টি। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছেÑ ৭.৬২ মিমি রাইফেল (চায়না) ১৮টি, ৭.৬২ মিমি এসএমজি-টি ৫৬ (চায়না) ৮টি, ৭.৬২ মি.মি. পিস্তল-টি ৫৪ (চায়না) ১৬টি, ৯ মিমি পিস্তল ৪২টি, ১২ বোর শটগান ৫৫টি, ৩৮ মি.মি. গ্যাস গান (সিঙ্গেল শট) ১৪টি, ৩৮ মি.মি. টিয়ার গ্যাস লঞ্চার (সিক্স শট) ২টি।
লুট হওয়া ৩৭ হাজার ৬৫৪ সার্ভিস রাইফেল/এসএমজি/এলএমজির গুলির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৩১ হাজার ১৬৫টি, উদ্ধার করা যায়নি ৬৪ হাজার ৮৯টি গুলি। লুণ্ঠিত ১ হাজার ৪৭০টি ৭.৬২*২৫ মিমি পিস্তলের সার্ভিস গুলির মধ্যে উদ্ধার করা গেছে ১ হাজার ৮৪টি, উদ্ধার হয়নি ৩৮৬টি। লুট হওয়া ৫ হাজার ২০০টি ৯*১৯ মিমি পিস্তলের সার্ভিস গুলির মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪ হাজর ৯৯টি, উদ্ধার হয়নি ১১০১টি। লুণ্ঠিত ২০ হাজার ৫০০টি রাবার বল কার্তুজের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১৬ হাজার ৯৮২টি, উদ্ধার হয়নি ৩ হাজার ৫১৮টি। লুট হওয়া ১৫ হাজার লিডবল কার্তুজের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৭ হাজার ৩৩১টি, উদ্ধার হয়নি ৭ হাজার ৬৬৯টি লিডবল কার্তুজ।
৫ আগস্ট রাতে থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট করে নিয়ে যাওয়া ৩ হাজার ১২০টি ৩৮ মিমি লংরেঞ্জ শেলের মধ্যে সিএমপি উদ্ধার করতে পেরেছে ২ হাজার ৭৩০টি, উদ্ধার হয়নি ৩৯০টি মি. লংরেঞ্জ শেল। ১ হাজার ৭৮০টি ৩৮ মিমি শর্টরেঞ্জ শেলের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ৫৯০টি, উদ্ধার হয়নি ১৯০টি। লুট হওয়া ২২১টি মাল্টি ইমপেক্ট গ্রেনেডের মধ্যে উদ্ধার ২০৬টি, উদ্ধার হয়নি ১৫টি। ৬৪৮টি সাউন্ড গ্রেনেডের মধ্যে উদ্ধার হয়েছে ৪১৩টি, উদ্ধার হয়নি ২৩৫টি। ৩৩৪টি টিয়ার গ্যাস হ্যান্ডগ্রেনেডের মধ্যে উদ্ধার ১৮৮টি, উদ্ধার হয়নি ১৪৬টি, ৩৭টি ফ্লাশ ব্যাংক গ্রেনেডের মধ্যে উদ্ধার ১০টি, উদ্ধার হয়নি ২৭টি। ৪৯৭টি মাল্টিপল আউটপুট নয়েজের (০৬ ব্যাং) মধ্যে উদ্ধার ৪৮২টি, উদ্ধার হয়নি ১৫টি। ওই রাতে লুট হওয়া ১৩টি স্ট্যান গ্রেনেড ও ১টি কালার স্মোক উদ্ধার করে সিএমপি।
থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া মরণঘাতী এসব আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি পুরোপুরি উদ্ধার না হওয়ায় আতঙ্ক বাড়ছে নগরীতে। দখল ও চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানান অপরাধমূলক কর্মকা-ে ব্যবহার হচ্ছে লুট হওয়া এসব অস্ত্র। শুধু তাই নয়, থানা পুলিশ থেকে খোয়া যাওয়া এসব অস্ত্র দিয়ে হত্যাকা-ের মতো ভয়ংকর ঘটনা ঘটাচ্ছে সন্ত্রাসীরা।
অপরাধ বিশ্লেষক এমদাদ হক বলেন, গণঅভ্যুত্থানে থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রগুলো ইতিমধ্যে সন্ত্রাসীদের হাতে চলে গেছে। সেগুলো দিয়ে তারা নানান ধরনের অপরাধমূলক কর্মকা- চালাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ংকর ও শঙ্কার বিষয় হলো, লুট হওয়া এসব অস্ত্র জাতীয় নির্বাচনে ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নির্বাচনের আগে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারলে চরম মূল্য দিতে হবে।
নগর ও জেলা পুলিশের তথ্যসূত্র বলছে, ১৭ জুন নগরীর মেরিন সড়ক থেকে পিস্তল ও গুলিসহ রুবেল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পিস্তলটি থানা থেকে লুট হওয়া ছিল বলে পুলিশের কাছে স্বীকারোক্তি দেয় রুবেল। গত বছরের ২৯ আগস্ট নগরের বায়েজিদ-হাটহাজারী থানার সীমানা এলাকায় মাসুদ কায়সার ও আনিস নামে দুই ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচটি গুলির খোসা (শটগানের কার্তুজ) উদ্ধার করা হয়। সেগুলোও লুট করা গুলির খোসা বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। চলতি বছর ৩ মার্চ জেলার সাতকানিয়ায় গোলাগুলির পর পিটুনিতে দুজনের মৃত্যু হয়। পরে ঘটনাস্থল থেকে ৯ এমএম একটি পিস্তল উদ্ধার করে পুলিশ। অনুসন্ধান করে পুলিশ নিশ্চিত হয়, সেটিও থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র।
১৭ এপ্রিল নগরের ডবলমুরিং থানার বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে আরিফ নামের এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় তার আস্তানা থেকে যেসব পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়, সেগুলোও থানা থেকে লুট করা। থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ডাকাতি ও ছিনতাই করত আরিফ। গত ২৫ জানুয়ারি ঝরনাপাড়ায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১৬টি গুলি, ১টি রাবার বুলেটসহ তিনজন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি চৌমুহনী এলাকার চারিয়াপাড়ায় অভিযান চালিয়ে অস্ত্রসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ডবলমুরিং থানা পুলিশ। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এসব অস্ত্র থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র বলে স্বীকার করে গ্রেপ্তারকৃত ৬ ছিনতাইকারী। গত ২১ জুলাই চান্দগাঁওয়ে ‘সন্ত্রাসী’ ইসমাইল হোসেন ওরফে টেম্পো ও শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইসার বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় ব্যবহৃত হয় সিএমপি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া দুটি গুলি ও গুলির খোসা উদ্ধার করে পুলিশ এবং থানা থেকে লুট হওয়া গুলি হিসেবে শনাক্ত করে তারা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) মুখপাত্র এডিসি শ্রীমা চাকমা বলেন, গত বছরের ৫ আগস্ট থানা থেকে মোট ৯৪৮টি অস্ত্র লুট হয়েছিল। ইতিমধ্যে ৭৯৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও বলেন, অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে সিএমপি। একই সাথে থানা পুলিশকেও এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন