‘শিউলি ফোঁটে, শিশির ঝড়ে, চাঁদ হাসে ওই গগনে, শরৎ এলো আনন্দেরই বার্তা নিয়ে সনে’ কবিতার লাইনটির মতোই যেন আনন্দে ভাসছে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষজন। আজ রোববার শুভ মহালয়ার মাধ্যমে আশ্বিনের সাদা পেজো তুলার মতো মেঘে ভেসে আসছে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তা। আজ দেবীপক্ষের সূচনায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে যাবে শারদীয় দুর্গোৎসবের আমেজ।
আজ ভোর সাড়ে ৫টায় শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হবে শারদ উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবী পক্ষের শুরুর তিথি এই মহালয়া। ‘মহালয়া’ কথাটি এসেছে মহালয় থেকে। মহালয়া হলো শারদীয়া দুর্গাপূজার আগে অমাবস্যা অর্থাৎ আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অমাবস্যা। আর দুর্গোৎসবের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্বেরও একটি মহালয়া। অপর দুটি হচ্ছেÑ বোধন ও সন্ধিপূজা। দুর্গাপূজার প্রস্তুতি পর্ব বা মহালয়ার প্রথম প্রহরে শেষ হয় পিতৃপক্ষের, আর শুরু হয় দেবীপক্ষের। একইসঙ্গে দুর্গাপূজার মূল অংশের প্রস্তুতি পর্ব হয়। তাই ভোর হতেই সব পূজাম-পে পুরোহিতের ভক্তিকণ্ঠে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেন সংস্থিতা-নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমোঃ নমোঃ’ মন্ত্র উচ্চারণ শোনা যায়। এরপর ঘনঘটার অমাবস্যা তিথিতে প্রাণে দ্যোতনা তুলে ঢাকে পড়বে কাঠি। এর ঠিক সাত দিন পরই শুরু হবে মহাষষ্ঠী পূজার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে দুর্গোৎসব।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা বলেন, আজ (রোববার) ভোর ৬টা থেকে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে মহালয়ায় বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বনানীতে পূজা শুরু হবে ভোর ৫টায়। সেখানে নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন প্রধান অতিথি থাকবেন। ঢাকেশ^রী মন্দিরে ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা এবং নেপালের রাষ্ট্রদূত ঘণশ্যাম ভা-ারিসহ ভুটানের দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন। পরে সকাল ৯টায় তিলতর্পণ এবং এরপর মহালয়ার ঘট স্থাপন ও পূজা সম্পন্ন হবে।
পূজা উদপাযনে কোনো বিঘেœর শঙ্কা রয়েছে কি নাÑ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের র্যাব, বিজিবি, সেনাবাহিনী, পুলিশ সবাই তৎপর রয়েছে। সবাই আশ^স্ত করেছেন কোনো ধরনের আশংকা নেই। আশা করছি, সবাই উৎসবমুখর পরিস্থিতিতে পূজা উৎযাপন করতে পারবে।
পঞ্জিকামতে, ২৮ সেপ্টেম্বর রোববার মহাষষ্ঠীর মাধ্যমে দেবীর বোধন শুরু হবে। এরপর সোমবার ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হবে মহাসপ্তমী। দেবী এবার গজ বা হাতিতে চড়ে আসছেন মর্ত্য।ে এর ফলে পৃথিবী সুখ ও সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে বলে বিশ্বাস সনাতন ধর্মাবলম্বীদের। ২ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমী। দোলা বা পালকিতে কৈলাসে গমন করবেন দেবী দুর্গা। দেবী দুর্গার এমন গমনের ফলস্বরূপ মহামারি, ভূমিকম্প এবং অতিমৃত্যুর মতো দুর্যোগ দেখা দিতে পারে বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে।
মন্ডপে মন্ডপে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ : এদিকে দুর্গাপূজাকে ঘিরে এখন মন্ডপে মন্ডপে চলছে প্রতিমা তৈরির কাজ। অধিকাংশ মন্ডপেই প্রতিমার কাঠামো তৈরি হয়ে গেছে। এখন চলছে রং-তুলির আঁচড় দেওয়ার কাজ। পূজার দিন যত এগিয়ে আসছে, শিল্পীদের ব্যস্ততা ততটাই বাড়ছে। দম ফেলার ফুসরত নেই প্রতিমা শিল্পীদের। পাশাপাশি আলোকসজ্জা, প্যান্ডেল তৈরি ও আনুষঙ্গিক সাজসজ্জার কাজও চলছে। অন্যদিকে দুর্গোৎসব উপলক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন কেনাকাটায়, বাড়ি ও আশপাশের আঙিনা পরিষ্কারের কাজে।
সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রাজারবাগ কালীমন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন ও রমনা কালি মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতি বছরের মতো এবারো দুর্গাপূজা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সেখানে প্রতিমার অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এখন শুরু হবে রং করার কাজ।
রমনা কালীমন্দিরের শিল্পী রতন পাল জানান, প্রতিমা তৈরির যাবতীয় কাজ প্রায় শেষের দিকে। এরপর রঙের কাজ শুরু হবে। তারপর প্যান্ডেলের সাজসজ্জা করা হবে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কালীমন্দির প্রাঙ্গণে তিন দিনব্যাপী মেলা চলছে। পূজাকে কেন্দ্র করে মেলার পরিবেশ জমজমাট। রোববার মেলা শেষ হবে।
রমনা কালীমন্দিরের পুরোহিত হরিচাঁদ চক্রবর্তী বলেন, আজ রোববার ভোর সাড়ে ৫টায় মহালয়ার মধ্য দিয়ে মর্ত্যে দেবীর আগমন ঘটবে। আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্টী, ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী ও পহেলা অক্টোবর মহানবমী পূজা হবে। এরপর ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর পূজা শেষে মা দূর্গা আবারও কৈলশে ফিরে যাবেন। ওইদিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ৫ দিনব্যাপী দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।
পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। এই পূজার জন্য সবাই সারা বছর উদগ্রীব হয়ে থাকেন। ইতোমধ্যে পূজার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। প্রতিমা তৈরি ও সাজসজ্জার পাশাপাশি পূজার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ চলছে। এ নিয়ে ইতোমধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া মন্দির ও ম-পের পক্ষ থেকেও নিজস্ব নিরাপত্তার প্রস্তুতি রাখতে সারা দেশে পূজার আয়োজকদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পূজা উদযাপন পরিষদের হিসাবে এ বছর সারা দেশে প্রায় ৩৩ হাজারের বেশি পূজাম-পে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। গত বছরের তুলনায় এবার পূজাম-পের সংখ্যা ১ হাজার বাড়ছে বলে জানা গেছে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন