জামায়াত মোকাবিলায় পাল্টা চাল বিএনপির

নির্বাচনের দিন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে উত্তপ্ত হচ্ছে দেশের রাজনীতির মাঠ। রাজনীতির দাবার বোর্ডে বেশ হিসাব করেই ঘুঁটির চাল দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। যেখানে বিএনপিকে বেশ সতর্কভাবেই চেক দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। এদিকে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবিতে নড়েচড়ে বসেছে বিএনপি। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থিদের উত্থান, বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ইসলামপন্থিদের একজোট হওয়ার যে প্রচেষ্টা চলছে, তা বিএনপিকে ভাবনায় ফেলেছে। দলটির নীতিনির্ধারণী নেতারা মনে করছেন, বর্তমানে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে ইসলামপন্থিরা বিএনপির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এমন প্রেক্ষাপটে ইসলামপন্থি ‘ভোট ব্যাংক’ বিবেচনায় রেখে বিএনপিও পাল্টা কৌশল আঁটছে বলে জানা গেছে। 

এরই মধ্যে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশসহ অন্তত সাতটি দল একাট্টা হয়ে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে এক রাউন্ড আন্দোলন সেরে ফেলেছে। যদিও আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকেই ইসলামপন্থি ভোট এক ছাতার নিয়ে আনার পরিকল্পনা করে আসছিল জামায়াত। সেই লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন দলের সঙ্গে যোগাযোগসহ স্থানীয় পর্যায়ে মাঠ গোছাতে কাজ করে যাচ্ছে। এদিকে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীদের মনোনয়ন বা গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার বিষয়টি গুজব ও মিথ্যা বলে জানিয়েছেন দলটির মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী। তিনি জানান, একাধিক প্রার্থী থাকায় বিরোধপূর্ণ আসনগুলোর নেতাদের ঢাকায় ডেকে কথা বলে সমঝোতা করছেন দলের সিনিয়র নেতারা।

এদিকে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, জামায়াত যখন এমন আটঘাঁট বেঁধে ইসলামি মতাদর্শের ভোট এক বাক্সে নিতে কাজ করছে, বিপরীতে বসে নেই বিএনপিও। বিভিন্ন ইসলামি দলের পাশাপাশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগও অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে বিএনপি। এরই মধ্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক মুফতি খলিল আহমদ কাসেমী ও প্রধান শায়খুল হাদিস শেখ আহমদ এবং শর্ষিনা দরবার শরিফের পির শাহ আবু নছর নেছার উদ্দিন আহমদ হোসাইনের সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমদ সাক্ষাৎ করেছেন। তারা নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির জন্য দোয়া, পরামর্শ ও সহযোগিতা চেয়েছেন। মূলত জামায়াতের সঙ্গে যেসব ইসলামি দলের আদর্শিক দূরত্ব রয়েছে, তাদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিএনপি। 

বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, দেশের বিভিন্ন এলাকার ধর্মীয় নেতা, বড় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বা খানকা শরিফের পির-মাশায়েখদের সঙ্গেও বিএনপি নেতাদের সৌজন্য সাক্ষাতের পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেবল বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারাই যে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন তা নয়; অঞ্চলভিত্তিক কেন্দ্রীয় নেতাদেরও দায়িত্ব দেওয়া হবে, যাতে ভোটের সময় বিএনপির প্রতি তাদের সমর্থন থাকে। বিশেষ করে ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বা মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সমর্থন যাতে কোনো পক্ষের দিকে একতরফা হয়ে না যায়। বিএনপি এবার সমাজের উচ্চ শ্রেণি থেকে একেবারে নি¤œ শ্রেণির মানুষের কাছে যাচ্ছে তাদের বোঝানোর জন্য। মানুষ কেন বিএনপিকে ভোট দেবে না, তা-ও জানার চেষ্টা করছে তারা। 

সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজ এলাকায় প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন গত রমজান মাস থেকেই। অনেকে তারও আগ থেকেই নিজের অবস্থান জানান দিয়েছেন নির্বাচনি এলাকায়। নির্বাচন সামনে রেখে সম্প্রতি গুলশানে বিএনপির চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিভিন্ন জেলার নেতাদের ডেকে কথা বলছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। গুলশান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সম্ভাব্য এসব প্রার্থীকে দলের ঐক্য বজায় রাখার জন্য তৎপর থাকতে বলা হচ্ছে। বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলার নেতাদের বৈঠকের ছবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে সবুজ সিগন্যালের খবর ছড়াতে দেখা যায়। অনানুষ্ঠানিক বৈঠকের পাশাপাশি দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দলীয় জরিপ ও একাধিক সংস্থার মাঠ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছেন। 

সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকে প্রার্থী মনোনয়ন প্রাথমিকভাবে ঠিক করার দায়িত্ব দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওপর ন্যস্ত করা হয়। তিনি যেসব আসনে একক প্রার্থী আছেন, দলীয় ঝামেলা নেই বললেই চলে, সেসব আসনের নেতাদের এলাকায় নির্বাচনি কাজ শুরুর সবুজ সংকেত দিচ্ছেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এরপর প্রার্থীদের প্রাথমিক তালিকা স্থায়ী কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে আলোচনার পর সংযোজন-বিয়োজন শেষে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। পরে তা সাংগঠনিকভাবে প্রার্থীদের জানিয়ে দেওয়া হবে। তারপর চূড়ান্তভাবে দলের মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থীর তালিকা করবে। বিএনপি সূত্র বলছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এখনো সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি। যারা কেন্দ্রের ‘সবুজ সংকেত’ হিসেবে নিজ এলাকায় প্রচার চালাচ্ছেন, তারা অনেকেই মনোনয়ন পাবে না বলেও মনে করে সূত্রটি। 

যদিও গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, উপযুক্ত সময়েই দলের নির্ধারিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যাচাই-বাছাই করে যোগ্য ও সর্বোপরি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য জনপ্রিয় প্রার্থীকেই বেছে নিয়ে তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। কোনো প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল বা সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি এখনো।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু পত্রপত্রিকা, গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিএনপির মনোনয়নের কথিত তালিকা, নাম প্রকাশ করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি, অসন্তোষ এবং বিশৃঙ্খলা উসকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপিতে বিভেদ সৃষ্টির জন্য কিছু মিডিয়া মিথ্যা অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত হয়েছে। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।’

বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, বিএনপি যে রাজনীতি করে, তা জামায়েতের সঙ্গে মিলবে না। সবাই তো আর একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারি হবে না। জামায়াতের যেমন কিছু কৌশল আছে, বিএনপিরও নিশ্চয়ই কিছু কৌশল আছে ভোট টানার। যারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে, তারা বিএনপিকে ভোট দেবে। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, জামায়াতের কৌশল নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয় বিএনপি। বিএনপি বড় দল, ভোটারও অনেক বেশি। যাদের ভোট কম, তারা কৌশল গ্রহণ করবে। বিএনপিকে মানুষ ভোট দেবে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তার জন্য। বিএনপি মানুষের ভাত ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গত ১৭ বছর লড়াই করেছে।