দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এরপর অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা। এবার তা গাজা উপত্যকায় একটুখানি আশার আলো দেখাচ্ছে। কিন্তু সেই আশা বেশিক্ষণ টেকেনি। হামাস পরিকল্পনাটিতে ইতিবাচক সাড়া দিলেও ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত থাকায় যুদ্ধবিরতির বাস্তবায়ন নিয়ে দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা। তবে গাজার বাসিন্দা ৩৭ বছর বয়সি আব্দুর রহমান আবু ওয়ারদা এখনো আশাবাদী। তিনি মনে করেন, উত্তর থেকে দক্ষিণে মানুষের যাত্রা বন্ধ হওয়াটা প্রমাণ করে, সবাই শান্তির প্রত্যাশায় আছে।
৪৪ বছর বয়সি মোহাম্মদ আবু দাহরুজ বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম যুদ্ধ থামবে। কিন্তু হামাসের ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার পরদিনই ইসরায়েল ৭০ জনকে হত্যা করল। ট্রাম্পের আহ্বানকে উপেক্ষা করে ইসরায়েলের এ আচরণ ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ দেয়। ৪০ বছর বয়সি সাত সন্তানের মা সানা আল-আবেদ সংবাদ শোনাই বন্ধ করে দিয়েছেন। তার কথায়, আমরা আর কিছুই বিশ্বাস করি না। প্রতিবারই আমাদের আশার পরিণতি হয় ধ্বংস। ৭২ বছর বয়সি সুলায়মান বাখিতের কণ্ঠে হতাশা, আমাদের মতামত কেউ জানতে চায় না। সম্মান, মর্যাদা; সব হারিয়ে ফেলেছি। তবু প্রতিদিন প্রার্থনা করি যুদ্ধ থামুক।’ অনেকে মনে করছেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা শান্তির চেয়ে নতুন দখলদারিত্বের পথ খুলে দিতে পারে। আবু দাহরুজ বলেন, হামাসকে নিরস্ত্র করা, আন্তর্জাতিক বাহিনী এনে গাজা শাসনের প্রস্তাব; এসব কোনোভাবেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে সহায়ক নয়। আবু ওয়ারদা ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘টনি ব্লেয়ার প্রশাসক, আন্তর্জাতিক বাহিনী, সাহায্য; সবই মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। আমরা শুধু নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা চাই।’ বাখিতের মতে, ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে অথচ আলোচনায় বসছে, এটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য? তারা যুদ্ধবিরতির কাগজে সই করলেও বোমা ফেলা থামাবে না।
এ যুদ্ধের ধাক্কা বহন করছেন লাখো গাজাবাসী। সানা আল-আবেদ বলেন, ‘দুই বছর ধরে রাস্তায় আছি। শীত আসছে, আমাদের কাছে নেই কম্বল, নেই টেন্ট।’ আবু ওয়ারদা যোগ করেন, একটি টেন্টের দাম হাজার ডলার। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে, ট্রাকে মালপত্র নেওয়ার খরচও বহন করতে পারছি না। ডা. আবু দাহরুজ বলেন, ‘আমি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করতাম। এখন নিজের সন্তানদেরই খাবার দিতে পারি না। আমাদের মর্যাদা ঘরের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছে। গত বছর ইসরায়েলি হামলায় তিনি হারিয়েছেন নিজের তিন সন্তানকে; আহমাদ (১২), লায়ান (৭) এবং মাসা (দেড় বছর)। বাখিতের মেয়ে বুশরা নিহত হয়েছেন তিন মাস আগে খাদ্যসহায়তা সংগ্রহের সময়।’ তিনি বলেন, ‘দুই বছর ধরে আমরা নরকের মধ্যে বেঁচে আছি। বিশ্ব শুধু আলোচনা করছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না।’ তবু আবু ওয়ারদা আশাবাদী কণ্ঠে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, যুদ্ধ থামবে, আমরা আবার গড়ে তুলব সবকিছু যা হারিয়েছি।’
এদিকে গাজা দখলের অভিযান সীমিত করার নির্দেশ দিয়েছে দখলদার ইসরায়েল সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দেশটির রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত সামরিক রেডিও নেটওয়ার্ক ‘আর্মি রেডিও’ এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। আর্মি রেডিওর সামরিক সংবাদদাতা দোরন কাদোশ এক্সে (সাবেক টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে জানান, সেনাবাহিনীকে গাজায় সব ধরনের অভিযান ‘সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনার’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে শুধু ‘প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ’ নেওয়ার অনুমতি রয়েছে সেনাদের। তিনি আরও জানান, এর অর্থ হচ্ছে গাজা সিটি দখলের অভিযান আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রস্তাবিত শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের প্রস্তুতির অংশ। এ নির্দেশনার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, শুক্রবার রাতে সেনাপ্রধান জেনারেল এয়াল জামির শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি বিশেষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা সভা করেছেন।
গাজা উপত্যকা থেকে মঙ্গলবার ইসরায়েলি ভূখ-ে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী (আইডিএফ)। সংবাদ সংস্থা এএফপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের দ্বিতীয় বার্ষিকীর দিনে এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার চালানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজা উপত্যকা থেকে একটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ঘটনা শনাক্ত করার দাবি করেছে আইডিএফ। আইডিএফ-এর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ইসরায়েলি ভূখ-ে একটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রবেশের ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে।ধারণা করা হচ্ছে সেটি ইসরায়েল সীমান্তের ভেতরেই পড়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।’
বিবৃতিতে আরো জানানো হয়, ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত হওয়ার পর গাজার উত্তর সীমান্তবর্তী এলাকা নেটিভ হাসারায় সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে। উল্লেখ্য, দুই বছর আগে একই দিনে হামাসের আকস্মিক হামলায় ইসরায়েলে প্রায় ১,২০০ জন নিহত হয়, যার জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। দখলদার ইসরায়েলিদের অভিযানে এখন পর্যন্ত গাজায় ৬৭ হাজার ১৬০ জন নিহত হয়েছে। যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
ব্রিটিশ শিক্ষার্থীদের মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভে যোগ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। কেননা, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে অতর্কিত হামলা চালিয়ে প্রায় ১২০০ জনকে হত্যা করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস। আর হামাসের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সেদিন থেকেই গাজায় হামলা চালিয়ে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে ইসরাইল। তাই, এই দিনে (৭ অক্টোবর) ফিলিস্তিনপন্থি বিক্ষোভ ‘অবিবেচক ও অ-ব্রিটিশ আচরণ’ বলেও মন্তব্য করেছেন স্টারমার। খবর বিবিসির।
গাজায় আগ্রাসনের খবর প্রচার করতে গিয়ে গত ২ বছরে প্রাণ হারিয়েছেন ২৭০ জনের বেশি সাংবাদিক। অর্থাৎ প্রতি মাসে গড়ে ১৩ জন পেশাগত কারণে নিহত হয়েছেন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট বা সিবিজের পরিসংখ্যান থেকে এ খবর জানা গেছে।সাংবাদিকদের ওপর সর্বশেষ নৃশংসতার ঘটনা ঘটে গত আগস্টে। খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে সংঘটিত ওই হামলায় মোট ২১ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আল জাজিরার মোহাম্মদ সালামা, রয়টার্সের হুসসাম আল মাসরি, এপির ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মরিয়ম আবু দাকা এবং ফটোগ্রাফার আহমেদ আবু আজিজ, মুয়াজ আবু ত্বাহা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন