মানবসভ্যতার ইতিহাসে হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সাল্লাম এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি একাই গোটা যুগের চিন্তাধারাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন তাওহিদের প্রতীক, শিরকের অন্ধকারে আলোর দিশারি। কিন্তু তাঁর নিজ পিতা আযর ছিলেন মূর্তি নির্মাতা ও উপাসক। ইবরাহিম (আ:) তাঁকে বারবার সত্যের পথে আহ্বান করেছেন, কিন্তু পিতা শিরকেই অনড় ছিলেন।
কিয়ামতের ময়দানে এই পিতা-পুত্রের পুনর্মিলনের এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা পাই সহিহ বুখারিতে বর্ণিত এক হাদিসে- আবূ হুরায়রা (রা:) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কিয়ামতের দিন ইবরাহিম (আ:) তার পিতা আযরের দেখা পাবেন। আযরের মুখম-লে কালি এবং ধুলাবালি থাকবে। তখন ইবরাহিম (আ:) তাকে বললেন, আমি কি পৃথিবীতে আপনাকে বলিনি যে, আমার অবাধ্যতা করবেন না? তখন তাঁর পিতা বলবে, আজ আর তোমার অবাধ্যতা করব না।
অতঃপর ইবরাহিম (আ:) আবেদন করবেন, হে আমার রব! আপনি আমার সঙ্গে ওয়াদা করেছিলেন যে, হাশরের দিন আপনি আমাকে লজ্জিত করবেন না। আমার পিতা রহম হতে বঞ্চিত হওয়ার চেয়ে বেশি অপমান আমার জন্য আর কী হতে পারে? তখন আল্লাহ বলবেন, আমি কাফিরদের জন্য জান্নাত হারাম করে দিয়েছি। পুনরায় বলা হবে, হে ইবরাহিম! তোমার পদতলে কী? তখন তিনি নিচের দিকে তাকাবেন। হঠাৎ দেখতে পাবেন তাঁর পিতার জায়গায় সর্বাঙ্গে রক্তমাখা একটি জানোয়ার পড়ে রয়েছে।
এর চার পা বেঁধে জাহান্নামে ছুড়ে ফেলা হবে। (বুখারি, হাদিস : ৩৩৫০)।
হাদিসের ব্যাখ্যা এই হাদিসটি বহু প্রাচীন ব্যাখ্যাকার ও মুহাদ্দিসগণ বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁরা একমত যে, আযর ইমানহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এবং ইবরাহিম (আ:)-এর দোয়া তাঁর মুক্তির কারণ হতে পারেনি। তবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাকে ‘লজ্জিত না করার’ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এক বিশেষ হিকমতের মাধ্যমে।
ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন: ‘এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ইবরাহিম (আ:)-এর পিতা আযর কাফির অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করেন। যদিও ইবরাহিম (আ:) দুনিয়ায় তাঁর জন্য ইস্তেগফার করেছিলেন, কিন্তু যখন আল্লাহ ঘোষণা করলেন যে, সে কাফির, তখন তিনি দোয়া বন্ধ করেন।’
তিনি আরও বলেন: ‘আযরকে জানোয়ারে রূপান্তরিত করা হয়েছিল যেন ইবরাহিম (আ:)-এর চোখে তাঁর পিতার দুঃখজনক পরিণতি না আসে এবং তাঁর মন ব্যথিত না হয়। এভাবেই আল্লাহ তায়ালা তাঁর প্রতিশ্রুতি ‘তোমাকে লজ্জিত করব না’ পূর্ণ করেছেন।’ (ফাতহুল বারী, খ- ৬, পৃ. ৪৭৮)।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন- ইমাম নববী ‘শরহ সহিহ মুসলিম’-এ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন- ‘ইবরাহিম (আ:)-এর আখিরাতের এই আবেদন আসলে তাঁর পিতার মুক্তির জন্য নয়, বরং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি স্মরণ করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ছিল। কারণ তিনি জানতেন, কাফিরের জন্য রহমত নেই। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, আল্লাহ যেন প্রতিশ্রুতির মর্যাদা রক্ষা করেন।’
তিনি আরও বলেন: ‘আযরকে পশুর রূপে পরিণত করা তাঁর অপমানের প্রতীক, এবং এভাবে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয়েছে কুফর ও শিরকের পরিণতি হিসেবে।’ (শরহ সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৮৬)।
ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন- ‘আযরের জানোয়ারে রূপান্তর একটি প্রতীকী ঘটনা- যাতে ইবরাহিম (আ:)-এর মনে আর মানবিক কষ্ট না থাকে। সেই রূপে তাঁকে আর পিতা বলে চিনতে পারবেন না।’ (আল-জামি’ লি আহকামিল কোরআন, সুরা আত-তাওবা: ১১৪)।
এই হাদিস শুধু আখিরাতের এক করুণ দৃশ্য নয়, বরং এ পৃথিবীর মানুষকে এক কঠোর সত্য স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ইমানই হচ্ছে সেই সম্পর্কের বন্ধন যা আল্লাহর নিকটে গণ্য, আর কুফর সেই বন্ধন যা সবকিছু ছিন্ন করে দেয়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন