ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গ-গোল লাগানোর চেষ্টা করেছেন বলে উল্লেখ করেছেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ তাজুল ইসলাম এ কথাগুলো বলেন। শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মামলায় এ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হয়েছে। এ সময় তাজুল ইসলাম এ কথাগুলো বলেন। একই দিনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক শেষে অ্যাটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্যের বিরোধিতা করে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেছেন, তার আসামি পালিয়ে যাননি, তাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে গতকাল চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের মধ্যে শেখ হাসিনা একটা সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) লাগানোর চেষ্টা করেছেন। সেনাবাহিনীকে বলার চেষ্টা করেছেন, তোমাদের অফিসারদের বিচার হয়, তোমরা কেন রুখে দাঁড়াচ্ছ না? শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলার অপর দুই আসামি হলেনÑ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এর মধ্যে মামুন নিজের দোষ স্বীকার করে ‘অ্যাপ্রুভার’ (রাজসাক্ষী) হয়েছেন।
তাজুল ইসলাম বলেন, যারা এখানে আসামি হয়েছেন, তাদের (শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান) মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। এত বড় অপরাধ করেছেন, দুনিয়ার সবাই জানে এই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তিনিও জানেন; কিন্তু কখনোই তার মধ্যে কোনো ধরনের অনুশোচনা পরিলক্ষিত হয়নি। উল্টো তিনি যারা তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন, সাক্ষ্য দিচ্ছেন, তাদের হত্যা করার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। তাদের বাড়িঘর ধ্বংস করে দেওয়ার কথা বলছেন। তাদের লাশগুলো বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন।
তিনি বলেন, সর্বশেষে তিনি (শেখ হাসিনা) রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে গ-গোল লাগানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি সেনাবাহিনীকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সেনাবাহিনীকে বলার চেষ্টা করেছেন, তোমাদের অফিসারদের বিচার হয়, তোমরা কেন রুখে দাঁড়াচ্ছ না? রাষ্ট্রের মধ্যে একটা সিভিল ওয়ার (গৃহযুদ্ধ) লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী সেই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। বাংলাদেশের জনগণ সেই পাতা ফাঁদে পা দেয়নি। যারা পারপিট্রেটর (অপরাধী) ছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তাদের অঙ্গীকারের প্রতি দৃঢ় আছেন। আদালতে তাদের নিয়ে এসেছেন। বিচারের প্রক্রিয়া স্মুথলি সামনে পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কোনো উসকানিতে কেউ পা দেয়নি।
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, এ রকম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ, পুরো প্রজন্মকে হত্যা করে ফেলার চেষ্টা, ৩৫ হাজার মানুষকে আহত করা, অঙ্গহানি করা, এরপরও সামান্যতম রিমোর্স (অনুশোচনা) না থাকা। এখানে শিশু ছিল, নারী ছিল, মজুর ছিল, ছাত্ররা ছিল, তাদের হত্যা করতে তার বুক কাঁপেনি। এখন পর্যন্ত তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। সুতরাং সর্বোচ্চ শাস্তিটা তার অবশ্যই প্রাপ্য।
হাসিনা পালিয়ে যাননি, চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে: আইনজীবী
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক শেষে অ্যাটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্যের বিরোধিতা করে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেছেন, তার আসামি পালিয়ে যাননি, তাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। গতকাল ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলাটির যুক্তিতর্ক শেষে সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান।
বক্তব্যের একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কী এমন হলো যে তাকে (শেখ হাসিনা) পালিয়ে যেতে হলো? ওনারা খুন করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। প্রসিকিউশন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন। তারা জানতেন বিচার হবে। তাই পালিয়ে গেছেন।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, ‘ওনারা (যারা অপরাধ করেছে) সব খবর রাখছেন। জানেন কী হচ্ছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওনারা এই ট্রাইব্যুনালের হাজির হবেন না। সন্দেহাতীতভাবে আমরা তাদের অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছি। অ্যাপ্রুভার রয়েছেন। সলিড পিস অব এভিডেন্স (বস্তুগত সাক্ষ্য), সারকামস্টেন্সিয়াল এভিডেন্সÑ সব কিছু সন্দেহাতীতভাবে এই বিচার প্রমাণ করবে।’ তিনি বলেন, যেসব সাক্ষ্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের যেকোনো দেশে যেকোনো আদালতে প্রমাণিত হবে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে।
শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেছিলেন, “এই আইনে বিচার করা মানে আসামিকে হাত-পা বেঁধে নদীতে ফেলে বলা, ‘সাঁতার কাটো’।” তিনি বলেন, এ আইনটি (আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন, ১৯৭৩) রোম স্ট্যাটিউটের সঙ্গে ‘কমপেটিবল’ করা হয়েছে। সংবিধান এই আইনকে ‘প্রটেকশন’ দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আইনটির ১৯ ধারার কথা উল্লেখ করেন প্রধান কৌঁসুলি তাজুল। এ ছাড়া ভিডিও, অডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রে এনটিএমসি, বিবিসি এবং আলজাজিরার সঠিকতা যাচাইয়ের কথা উল্লেখ করেন। সব শেষে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, ‘মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, আমার আসামি পালিয়ে গেছেন। আমি বলতে চাই, তিনি পালিয়ে যাননি। তাকে চলে যেতে বাধ্য করা হয়েছিল।’
শেখ হাসিনাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি করার বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য প্রসঙ্গে আমির হোসেন বলেন, ‘যে কারণে ওই ব্যক্তি (তারেক রহমানকে ইঙ্গিত করে) দেশে আসেননি, আমার আসামিও সে কারণে দেশে আসছেন না।’ এরপর ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এ মামলার রয়ের তারিখ আগামী ১৩ নভেম্বর জানানো হবে বলে জানান।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন