সাধারণত রোদ ও বাতাসে শুকিয়ে মাছ শুঁটকি করা হয়। রোদে শুকানোর ফলে মাছের অতিরিক্ত জলীয় অংশ শুকিয়ে যায়, যা জীবাণু জন্মাতে বাধা দেয় এবং মাছকে দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু খুলনার পাইকগাছায় নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্রকাশ্যে কাঠ পুড়িয়ে চিংড়ি মাছ শুকানো হচ্ছে। বায়ুদূষণের ফলে ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন এলাকাবাসী।
এ ছাড়া তৈরি করা শুঁটকি মাছ মানসম্মত না হওয়ায় হুমকিতে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। বিশেষ করে ধোঁয়ায় পরিবেশ ও বায়ুদূষণ এবং জনস্বাস্থ্যে মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হলেও প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগের অভাবে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ কার্যক্রম চলমান।
সরেজমিনে দেখা যায়, পৌরসভার ৬ ও ৭ নম্বর ওয়ার্ডে কামাল হোসেন এবং দেবব্রত মিলে বাড়িঘরের মাঝখানে, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় শত শত মণ কাঠ পুড়িয়ে চিংড়ি মাছ শুকাচ্ছেন। অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ধোঁয়ার কু-লী আকাশ ঢেকে রাখে, চারপাশের বাতাস ভারি হয়ে যায়। এতে একদিকে পথচারীরা শ্বাসকষ্টে ভোগেন অন্যদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা ঘরবন্দি হয়ে চরম কষ্টে দিন পার করছেন। এ ঘটনায় এলাকাবাসী অভিযোগ করলেও প্রতিকার পায়নি।
স্থানীয়রা জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই জনবসতির মধ্যে এ অবৈধ কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছেন কামাল ও দেবব্রত। চিংড়ি শুকানোর কাজে তারা কাঠের পাশাপাশি কেরোসিন তেল ও অন্যান্য দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করেন, যা থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
নীতিমালা অনুযায়ী, চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ বা শুকানোর মতো কার্যক্রম শিল্প এলাকা বা নির্ধারিত ফুড প্রসেসিং জোনে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে পরিচালনা করার নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু পাইকগাছার ব্যবসায়ীরা সেই নীতিমালা অমান্য করে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য উভয়ের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ধারা ৬(ক) অনুসারে, যে কোনো শিল্প বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন সনদ (ঊহারৎড়হসবহঃধষ ঈষবধৎধহপব ঈবৎঃরভরপধঃব) গ্রহণ বাধ্যতামূলক। আইন অমান্য করলে দ-বিধি অনুযায়ী জরিমানা ও কারাদ-ের বিধান রয়েছে। তদুপরি, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২৩ অনুযায়ী জনবসতিপূর্ণ এলাকায় কাঠ বা অন্য কোনো বায়ুদূষণকারী জ্বালানি ব্যবহার করে এমন শিল্প বা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
স্থানীয় কবির হোসেন বলেন, কারখানার ধোঁয়ায় আমাদের বাচ্চারা কাশি ও শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ধোঁয়ার গন্ধে ঘরের ভেতরেও থাকা যায় না। আমরা বহুবার মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রোদে শুকানো শুঁটকি শরীরের শক্তি জোগায়, হাড় ও রক্তের জন্য উপকারী, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। কিন্তু চিংড়ি শুকানোর সময় কাঠে কেরোসিন তেল ব্যবহার করলে তাতে থাকা রাসায়নিক উপাদান চিংড়ির মধ্যে প্রবেশ করে। এসব মাছ নিয়মিত খেলে ফুসফুস, লিভার ও কিডনি জটিলতা, এমনকি ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত কামাল হোসেন ও দেবব্রত জানান, আমরা দীর্ঘদিন ধরে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছি। কেউ আমাদের কিছু বলেনি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহেরা নাজনীন বলেন, লোকালয়ে কাঠ পুড়িয়ে মাছ শুকানো সম্পূর্ণ অবৈধ ও পরিবেশবিরোধী। বিষয়টি আমরা জেনেছি, তদন্ত করে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
জেলা সিভিল সার্জন অফিসের সিনিয়র স্বাস্থ্য শিক্ষা অফিসার মো. মাহবুবুর রহমান জানান, কাঠ ও মাছের সম্মিলিত ধোঁয়ায় স্থানীয়দের শ্বাসকষ্টসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হবে। আর যে প্রক্রিয়ায় চিংড়ির শুঁটকি বানানো হচ্ছে, তাতে লিভারসহ পরিপাকতন্ত্রের ভয়াবহ ক্ষতি হবে।
পরিবেশবিদরা বলছেন, এ ধরনের কর্মকা- অবিলম্বে বন্ধ করে টেকসই ও স্বাস্থ্যসম্মত বিকল্প প্রক্রিয়া চালু না করলে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রা ও পরিবেশ উভয়ই বিপন্ন হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মমতাজ বেগম বলেন, পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়া কেউ এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। অভিযোগ পেলে পরিদর্শন করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন