মানুষের জীবন শুধু দৃশ্যমান কর্মের সমষ্টি নয়; তার অন্তর, নিয়ত ও অদৃশ্য তাকদির; এই তিনের রহস্যেই লুকিয়ে আছে তার চূড়ান্ত পরিণতি। মানুষ যতই পরিকল্পনা করুক, আল্লাহর নির্ধারিত ফয়সালার বাইরে সে এক কদমও যেতে পারে না। তবুও ইসলামের শিক্ষা হলো; আমল চালিয়ে যাওয়া, নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা এবং আল্লাহর রহমতের প্রতি আশা হারিয়ে না ফেলা। এই সত্যটিই মহানবী (সা.) এক গভীর হাদিসে তুলে ধরেছেন, যা তাকদির, নিয়ত ও জীবনের শেষ পরিণতির বাস্তব চিত্র স্পষ্ট করে দেয়-
আবদুল্লাহ্ ইবনু মাসঊদ (রা.) হতে বর্ণিত।
তিনি বলেন, সত্যবাদী ও সত্যবাদী হিসেবে স্বীকৃত রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকেই আপন আপন মাতৃগর্ভে চল্লিশ দিন পর্যন্ত (শুক্র হিসেবে) জমা থাকে। তারপর ওই রকম চল্লিশ দিন রক্তপি-, তারপর ওই রকম চল্লিশ দিন মাংস পি-াকারে থাকে। তারপর আল্লাহ্ একজন ফেরেশতা পাঠান এবং তাকে রিজিক, মৃত্যু, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্যÑ এ চারটি বিষয় লেখার জন্য আদেশ দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আল্লাহর কসম! তোমাদের মাঝে যে কেউ অথবা বলেছেন, কোনো ব্যক্তি জাহান্নামিদের আমল করতে থাকে।
এমনকি তার ও জাহান্নামের মাঝে মাত্র এক হাত বা এক গজের তফাৎ থাকে। এমন সময় তাকদির তার ওপর প্রাধান্য লাভ করে আর তখন সে জান্নাতিদের আমল করা শুরু করে দেয়। ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। আর এক ব্যক্তি জান্নাতিদের আমল করতে থাকে।
এমন কি তার ও জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাত বা দুহাত তফাৎ থাকে। এমন সময় তাক্িদর তার ওপর প্রাধান্য লাভ করে আর অমনি সে জাহান্নামিদের আমল শুরু করে দেয়। ফলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করে। (বুখারি, হাদিস : ৬৫৯৪; মুসলিম, হাদিস : ২৬৪৩)।
বিখ্যাত মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যা:
ইমাম নববী (রহ.)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন: ‘এই হাদিসের অর্থ এই নয় যে মানুষ সত্যিকার অর্থে জান্নাতিদের আমল করছিল অথচ শেষে উল্টো হয়ে গেল; বরং এর অর্থ হলোÑ সে বাহ্যিকভাবে জান্নাতিদের আমল করছিল, অথচ তার অন্তরে ছিল না খালিস নিয়ত ও ঈমান। তাই শেষপর্যন্ত তার অন্তর প্রকাশ পেয়েছে।
(সহিহ মুসলিম, নববী, খ- ১৬, পৃ. ৩৬৬)।
অর্থাৎ, শেষের আমলই নির্ধারক’ যে যেমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে, তার পরিণতি তেমনই হয়।
ইবনে হাজর আল-আসকালানী (রহ.)
ইবনেহাজর (রহ.) ব্যাখ্যা করেন: ‘এ হাদিস তাকদিরের সত্যতার ওপর দৃঢ় প্রমাণ। আল্লাহ মানুষের পরিণতি এমনভাবে নির্ধারণ করেছেন যা মানুষের কাছে অজানা। বাহ্যিকভাবে কেউ ধার্মিক মনে হলেও যদি অন্তর কলুষিত হয়, আল্লাহর ইলমে জানা থাকে তার শেষ কীরূপ হবে।’ (ফাতহুল বারী, হাদিস: ৩২০৮)।
তিনি বলেন, মানুষের আমল তার নিয়ত অনুযায়ী ফলপ্রসূ হয়; যদি নিয়ত বিকৃত হয়, তবে আল্লাহ শেষ পর্যন্ত সেটি প্রকাশ করে দেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়ুম (রহ.)
ইবনুল কাইয়ুম বলেন: ‘মানুষের শেষ অবস্থা তার অভ্যন্তরীণ গুণাবলি ও নফসের অবস্থার প্রতিফলন। যদি কেউ আমল করে কিন্তু মনোভাব কলুষিত থাকে, তবে মৃত্যুর আগে তার অন্তর যা লুকিয়ে রেখেছে, তা প্রকাশ পায়, এটাই তাকদিরের প্রাধান্য। (শিফ্উাল আলিল, পৃ. ২১৩)।
ইমাম কুরতুবী (রহ.)
কুরতুবী বলেন: ‘এই হাদিস আমাদের শেখায়, কোনো ব্যক্তি তার আমল নিয়ে কখনো গর্বিত হওয়া উচিত নয়; বরং সর্বদা আল্লাহর ভয় ও দয়া কামনা করতে হবে।’ (আল-মুফহিম, খ- ৭, পৃ. ১৮৮)।
হাদিস থেকে শিক্ষা :
তাকদির সত্য: আল্লাহ প্রতিটি মানুষের জীবনের রিজিক, আমল, আয়ু ও পরিণতি পূর্বনির্ধারিত করেছেন।
মানুষ অজানা: কেউ জানে না তার শেষ পরিণতি কেমন হবে, তাই অহংকার নয়, বিনয় থাকা উচিত।
নিয়তের গুরুত্ব: বাহ্যিক আমল যতই ভালো হোক, নিয়ত বিকৃত হলে শেষ পরিণতি বিপর্যয়কর হতে পারে।
আখিরাতমুখী জীবন: আমল অব্যাহত রাখা ও অন্তরের বিশুদ্ধতা রক্ষা করা আবশ্যক।
আল্লাহর ভয় ও আশার সমন্বয়: ভয় বা খাওফ যেন হতাশায় না ফেলে, আর আশা যেন অলসতা না আনে।
এই হাদিস তাকদির, নিয়ত ও শেষ আমলের বাস্তবতা নিয়ে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। মানুষের বাহ্যিক আমল আল্লাহর নিকট তখনই গ্রহণযোগ্য হয়, যখন তার অন্তর ও নিয়তও খালিস হয়। আর যদি কেউ বাহ্যিকভাবে ধার্মিক দেখায়, অথচ অন্তরে কপটতা থাকে, তবে আল্লাহ তার শেষ আমল এমনভাবে ঘটিয়ে দেন যে, তার প্রকৃত চরিত্র প্রকাশ পায়। সুতরাং, মানুষের দায়িত্ব হলোÑ আমল চালিয়ে যাওয়া, নিয়ত বিশুদ্ধ রাখা, এবং সর্বদা আল্লাহর কাছে উত্তম পরিণতির দোয়া করা- এভাবে দোয়া করা যেতে পারে যে,
‘হে আল্লাহ! আমাদের কর্মসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম কর্মটি যেন হয় আমাদের শেষ কর্ম, এবং সর্বোত্তম দিনটি যেন হয় যেদিন আমরা আপনাকে সাক্ষাৎ করব।’ (আল-হাকিম, মুস্তাদরাক: ১/৭১৩)
আল্লাহ আমাদের সকলকে ভয় ও আশার ভারসাম্যতা রক্ষা করে আমলের তৌফিক দান করুন। আমিন।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন