ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলো কাঁপিয়ে দেওয়া শুক্রবার সকালের ভূমিকম্পকে বাংলাদেশের জন্য উচ্চ সতর্কবার্তা হিসেবে নিতে হবে। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার কম্পনে যে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র দেখা গেছে, তা স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলো ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে ৬ মাত্রা বা তার ওপরে ভূমিকম্প হলে ঢাকার বড় অংশ ভেঙে পড়তে পারে।
শুক্রবার সকাল ১০টা ৩৮ মিনিটে নরসিংদীর মাধবদী এলাকায় উৎপত্তিস্থল থেকে ২৬ সেকেন্ডের কম্পনে ঢাকার অসংখ্য ভবনে ফাটল, পলেস্তরা খসে পড়া, রেলিং ভাঙা এবং একাধিক স্থাপনা হেলে যাওয়ার ঘটনা দেখা গেছে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বহু মানুষ আহত হয়েছে। এই কম্পনকে এযাবৎকালে ঢাকার নিকটতম বড় উৎসস্থল বলে অভিহিত করা হচ্ছে।
গতকালের ভূমিকম্পটাকে ফোরশক বলা যায়। বড় ভূমিকম্প আসার আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়ে থাকে, এটি তারই একটি। ১৮৯৭ সালে এই অঞ্চলে ৮ দশমিক ১ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। এরপর থেকে সোয়াশ বছর পেরোতে চলেছে। ভূমিকম্পের ঐতিহাসিক চক্র অনুযায়ী, ১০০ থেকে ১৫০ বছরের মধ্যে বড় ভূমিকম্প ফেরার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেই হিসাবে ৭ মাত্রার ভূমিকম্পের সময় হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশকে প্রস্তুতির জন্য এখনই সতর্ক করছে।
ঢাকায় প্রায় ২১ লাখ ভবন রয়েছে। এর মধ্যে ৬ লাখ ভবন ছয়তলার ওপরে। বাকি প্রায় ১৫ লাখ ভবন একতলা থেকে চারতলা। নির্মাণসংক্রান্ত ত্রুটি, বিধিমালা অমান্য, দুর্বল ভিত্তি, অপরিকল্পিত নগরায়ণÑ সব মিলিয়ে এই উঁচু তলার ভবনগুলো বড় ভূমিকম্পে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রায় যতটা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, ৭ মাত্রার হলে তার কয়েক গুণ বেশি হবে। ঢাকা শহরের এক-তৃতীয়াংশ বা প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে। তখন ২ থেকে ৩ লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে।
এখনই পুরো মহানগরের ভবনগুলো পরীক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। রাজউককে দিয়ে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবেÑ ঢাকার সব ভবন পরীক্ষা করে সার্টিফিকেট দিতে হবে। পরীক্ষার পর সবুজ, হলুদ, লালÑ এই তিন রঙের কোডে ভবন চিহ্নিত করা হবে। এতে সরকারের তেমন কোনো খরচ হবে না, শুধু উদ্যোগ দরকার। সবুজ রং ভবন ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ। হলুদ/কমলা রং কমবেশি ঝুঁকিতে আছে, মজবুতকরণ প্রয়োজন। লাল রং অবিলম্বে বাসিন্দা সরিয়ে নিতে হবে, ভবন ভেঙে নতুনভাবে নির্মাণ বা শক্তিবৃদ্ধি জরুরি। এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ভারতের মতো ভূমিকম্পপ্রবণ দেশগুলো আগেই রংভিত্তিক চিহ্নায়নের মাধ্যমে ঝুঁকি নির্ণয় করে থাকে। রাজধানীর ভবনগুলো সঠিকভাবে পরীক্ষা ও শ্রেণিবিন্যাস করা হলে ভবিষ্যতের বড় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। রানা প্লাজা ধসের পর গার্মেন্টস ভবনগুলো পরীক্ষা করা হয়েছে। তখনই বোঝা গেছে, বিল্ডিং কোড না মানলে কী বিপর্যয় হয়। একইভাবে এখন ঢাকার ভবনগুলো পরীক্ষা করতে হবে। বিশ্বব্যাংক ভূমিকম্পসহ দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রাজউককে ১৮ কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছে, কিন্তু রাজউকের সক্ষমতা সীমিত হওয়ায় পূর্ণ পরিসরে কাজ শুরু হয়নি।
বাংলাদেশের নোয়াখালী থেকে শুরু করে কক্সবাজার পর্যন্ত একটি প্রধান টেকটোনিক ফাটল রয়েছে, যেটি সিলেট হয়ে ভারতের দিকে গেছে। নরসিংদী এই বড় ফাটলের একটি উপফাটল। তাই সেখানে ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ঢাকার এত কাছে এই মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনা আগে ঘটেনি, যা নতুন করে ভাবনার বিষয়। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে অপরিকল্পিতভাবে ভবন তৈরি হচ্ছে। বিল্ডিং কোড মানা হয় না। ফলে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে। বড় ভূমিকম্প হলে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, যোগাযোগব্যবস্থা, সবই ভেঙে পড়বে। উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনা অসম্ভব হয়ে উঠবে, এবং ঢাকায় দেখা দেবে মানবিক বিপর্যয়।
সব শেষে বলছি, এটি বড় ভূমিকম্পের আগাম বার্তা। পরিস্থিতি অবহেলা করার সুযোগ নেই। ভবন পরীক্ষা, শক্তিবৃদ্ধি ও কোড বাস্তবায়ন এখনই শুরু করতে হবে। সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। নগরায়ণ নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি বাড়াতে হবে। আরও বড় ভূমিকম্পের প্রস্তুতি হিসেবে উদ্ধারব্যবস্থাও উন্নত করা প্রয়োজন। কারণ গতকালের ভূমিকম্প মনে করিয়ে দিল, আমরা ভয়াবহ ঝুঁকির মধ্যে আছি। বড় ভূমিকম্প এলে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। তাই এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক, বুয়েট এবং ভূমিকম্প গবেষক

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন