বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার মূল ভিত্তিই হলো কৃষি। কিন্তু আজকের তরুণ প্রজন্ম কৃষিকাজ থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। শহরমুখী হওয়ার প্রবণতা, চাকরির পেছনে ছুটে চলা এবং কৃষিকে ছোট চোখে দেখার মানসিকতা আমাদের জাতীয় জীবনে এক গভীর সংকট তৈরি করছে। কৃষি শুধু একটি পেশা নয়, এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা যে খাবার খাই, তার সবকিছুই কৃষকের শ্রমের ফসল। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। জিডিপিতে কৃষির অবদান এখনো উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আধুনিক শিক্ষিত তরুণরা কৃষিকে আর সম্মানের চোখে দেখে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষিকাজ করেই জীবনযাপন করতেন। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এ ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। শহুরে জীবনের চাকচিক্য তাদের কৃষির শিকড় থেকে দূরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের কৃষি থেকে দূরে সরে যাওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, সামাজিক মর্যাদা। আমাদের সমাজে কৃষকদের এখনো নি¤œশ্রেণির মানুষ বলে মনে করা হয়। একজন তরুণ যখন বলে সে কৃষিকাজ করে তখন অনেকে তাকে হেয় চোখে দেখে। অথচ একজন ছোট চাকরিজীবীকেও সম্মানের চোখে দেখা হয়। দ্বিতীয়ত, আর্থিক অস্থিরতা। কৃষিকাজে লাভ-ক্ষতি উভয়ই আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, লোভী ব্যবসায়ীদের শোষণ - এসব কারণে কৃষকরা প্রায়ই ক্ষতিগ্রস্ত হন। একজন তরুণ নিশ্চিত আয়ের জন্য চাকরির দিকে ঝুঁকবে, এটাই স্বাভাবিক।
তৃতীয়ত, শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তরুণদের চাকরিমুখী করে তুলছে। স্কুল-কলেজে কৃষি সম্পর্কে বাস্তবমুখী শিক্ষা দেওয়া হয় না। বইয়ের পাতায় কৃষি থাকলেও মাঠে গিয়ে কৃষিকাজ শেখার সুযোগ নেই। ফলে তরুণদের মনে কৃষির প্রতি আগ্রহ জন্মায় না। চতুর্থত, প্রযুক্তির অভাব। আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া কৃষিকাজ এখন কষ্টসাধ্য এবং সময়সাপেক্ষ। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে যন্ত্রের মাধ্যমে কৃষিকাজ হয়, সেখানে আমাদের দেশে এখনো অনেক জায়গায় ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এ কষ্টকর কাজে তরুণরা আগ্রহী নয়। পঞ্চমত, শহরের প্রতি আকর্ষণ। শহরে চাকরি, ব্যবসা এবং আধুনিক জীবনযাপনের সুযোগ তরুণদের গ্রাম ছেড়ে শহরে আসতে উৎসাহিত করে। গ্রামীণ জীবনকে তারা পিছিয়ে পড়া এবং অনুন্নত মনে করে।
তরুণদের কৃষি থেকে দূরে সরে যাওয়ার ফলাফল অত্যন্ত মারাত্মক। প্রথমত, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে। কৃষকের সংখ্যা কমে গেলে কৃষি উৎপাদনও কমবে। আর উৎপাদন কমলে আমাদের খাদ্যের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে। এটা জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি।দ্বিতীয়ত, বেকারত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবাই যখন চাকরির পেছনে ছুটবে, তখন চাকরির চেয়ে চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি হবে। ফলে বেকারত্ব বাড়বে। অথচ কৃষিতে কাজের অভাব নেই। সঠিকভাবে কৃষিকাজ করলে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। তৃতীয়ত, গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে পড়ছে। তরুণরা গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে গেলে গ্রামের উন্নয়ন থেমে যায়। কৃষিজমি অনাবাদি থেকে যায়। গ্রামীণ বাজারে খারাপ প্রভাব পড়ে। চতুর্থত, ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। কৃষির সঙ্গে জড়িত প্রাচীন জ্ঞান, ফসল চাষের বিশেষ কৌশল, বীজ সংরক্ষণ- এসব জ্ঞান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হতো। কিন্তু তরুণরা কৃষি থেকে দূরে সরে গেলে এই মূল্যবান জ্ঞান হারিয়ে যাবে।
পঞ্চমত, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। শহরমুখী মানুষের চাপ বাড়ছে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামের পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কৃষিজমি বাড়িঘর বা অন্য কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এ সমস্যা সমাধানে সবার আগে প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। কৃষিকে সম্মানজনক পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমাজে কৃষকদের যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে। মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে ইতিবাচক ভূমিকা নিতে হবে।
সরকারকে কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে হবে। কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা, ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, কৃষি যন্ত্রপাতিতে ভর্তুকি- এসব পদক্ষেপ নিতে হবে। ফসলের বিমাব্যবস্থা জোরদার করতে হবে যাতে প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকরা সুরক্ষা পায়। কৃষি শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আধুনিক গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। কৃষি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। স্কুল-কলেজে কৃষিবিষয়ক ব্যবহারিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। স্মার্ট ফার্মিং, হাইড্রোপনিক্স, ভার্টিক্যাল ফার্মিং- এসব আধুনিক পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষিকাজ যখন সহজ এবং লাভজনক হবে, তখন তরুণরা স্বাভাবিকভাবেই আগ্রহী হবে। কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। শুধু ফসল উৎপাদন নয়, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মার্কেটিং, রপ্তানি- এসব ক্ষেত্রে তরুণ উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে হবে। কৃষি ব্যবসা কে লাভজনক শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। সফল তরুণ কৃষকদের গল্প প্রচার করতে হবে। যারা আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ করে সফল হয়েছেন, তাদের অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। এতে অন্য তরুণরা অনুপ্রাণিত হবে। কৃষি আমাদের জাতীয় জীবনের মেরুদ-। তরুণ প্রজন্ম যদি কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কৃষি মানে শুধু ঐতিহ্যবাহী লাঙল-জোয়াল নয়। আধুনিক কৃষি একটি বিজ্ঞানসম্মত, প্রযুক্তিনির্ভর এবং লাভজনক খাত হতে পারে। তরুণদের কৃষিতে ফিরিয়ে আনতে হলে সমাজ, সরকার এবং পরিবার- সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। কৃষিকে সম্মানজনক ও লাভজনক করে তুলতে পারলেই তরুণরা আবার মাটির কাছে ফিরে আসবে। আর তখনই আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থে স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ হবে।
কৃষি আমাদের সভ্যতার ভিত্তি, তাই আমাদের উচিত সবাই মিলে তরুণ প্রজন্মকে কৃষির প্রতি আগ্রহী করে তোলা এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ গড়া।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন