আমরা যখন কোনো সরকারকে একটি ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হিসাবে অভিহিত করি তখন ধরেই নিই যে সেটি দীর্ঘস্থায়ী কোনো সরকার হবে না। সেই হিসাবে আমাদের ধরে নিতে হয়েছিল ইউনূস সরকারের মেয়াদ হবে হয়তো সর্বনি¤œ ছয় মাস (যেটা ছিল ঈধৎবঃধশবৎ জাতীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মেয়াদ) অথবা তার চেয়ে আরও সামান্য বেশি। কিন্তু বেশি হলে তখন খুঁজে দেখতে হবে তা কত দিন হাত পারে? যারা এই সরকার তৈরি করেছিলেন তারা তাকে কি ঞবৎসং ড়ভ জবভবৎবহপব দিয়ে তৈরি করেছিলেন এবং সে জন্য তাকে কতটুকু সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন সেটাই ছিল তখন একটি অন্যতম রাজনৈতিক প্রশ্ন। সেটা কি ছয় মাস, এক বছর, দেড় বছর, দুই বছর, তিন বছর নাকি পাঁচ বছর নাকি অনির্দিষ্ট কোনো কাল? যদি পাঁচ বছর বা ততোধিক হয় তা হলে বুঝতে হবে এটি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হলো না, এটা একটি দীর্ঘমেয়াদি সরকার হলো যারা দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন। তখন তার অর্থনৈতিক ক্রিয়াকান্ডও হবে দীর্ঘমেয়াদি এবং তার অর্থনীতি মূল্যায়নের মানদন্ডও হবে দীর্ঘমেয়াদি। আমরা তখন তার কাছ থেকে নানা ধরনের মৌলিক অর্থনৈতিক কাঠামোগত সংস্কারের প্রত্যাশা করব এবং নিয়োগকারীর ইচ্ছা অনুযায়ী সেই সরকার সেগুলো পূরণের চেষ্টাও করবেন। নিয়োগকারীর কাছে ব্যর্থতা বা সাফল্য তখন সেগুলোর পূরণের মাত্রা দ্বারা নির্ধারিত হবে। ভুল হলে নিয়োগকারীরা তখন তাকে বদল করে দিবেন। যেভাবে একটি নির্বাচিত সরকারকে তার নির্বাচকমন্ডলী পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে সভ্য দেশে মূল্যায়ন ও বিদায় করে থাকেন। সেভাবে সম্ভব না হলেও ইউনূস সরকার নিজস্ব প্রণীত সংস্কারের একধরনের মূল্যায়নের সুযোগ গণভোটের মাধ্যমে জনগণকে অপ্রত্যক্ষভাবে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দিতে যাচ্ছেন বলে প্রতিভাত হচ্ছে।
কিন্তু আমরা মনে করি ইউনূস সরকার কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, তিনি ক্ষমতায় এসেছেন বা যারা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন তারা সেই সরকারের কাছে কিছু প্রত্যাশা করেছিলেন এবং তারা কিভাবে তাকে মূল্যায়ন করছেন সেটিও হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা পরিমাপের আরেকটি প্রধান মানদন্ড বা বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত। কিন্তু তারা কারা এবং তাদের প্রত্যাশা কি ছিল? তাকে কি শুধু সুষ্ঠু নির্বাচন প্রদানকারী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসাবে তারা দেখতে চান না কি দীর্ঘমেয়াদী সংস্কার প্রণেতা সরকার হিসাবে দেখতে চান সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে ধরে নিতে হবে প্রথমটিই হচ্ছে সত্য ও তার কাছে প্রত্যাশিত।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইউনূস সরকারের কাছে প্রত্যাশার স্বরূপ
১৫ বছর স্বৈরাচারের জগদ্দল পাথরের নিচে বসবাসকারী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইউনূস সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তবে হাসিনা সমর্থকদের মতে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন কোনো না কোনো গবঃরপঁষড়ঁং উবংরমহ-এর ফলে। হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের অপকর্মের জন্য হাসিনা সরকার বিতাড়িত হয়েছিল এ কথা তারা অবশ্য স্বীকার করতে অনিচ্ছুক। তাদের সন্দেহ এখানে সা¤্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র ছিল। এই সন্দেহ আরও দৃঢ়তর হয়েছে তখন যখন ড. ইউনূস নিজেই আমেরিকায় ভ্রমণের সময় তার বন্ধু হিলারি ক্লিনটনের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে সাক্ষাৎকালে বলেন যে তার ক্ষমতায় আরোহণের পেছনে ছিল একটি গবঃরপঁষড়ঁং উবংরমহ এবং সহযাত্রী জনাব মাহফুজকে এর প্রধান উবংরমহবৎ আখ্যা দেন।
সুতরাং ড. ইউনূসের কাছে বর্তমানে আমরা কী প্রত্যাশা করব তা দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রথমত, যদি আগস্ট আন্দোলনের স্বতঃস্ফূর্ত গণশক্তিই তাকে ক্ষমতায় বসিয়ে থাকে তা হলে তার নিয়োগকারী মূলত জনগণ। সেই জনগণ ও ছাত্রসমাজের বড় বড় সংস্কারের প্রত্যাশা নিশ্চয়ই থাকবে। প্রত্যাশা থাকবে তিনি স্বৈরাচারের বিচার শুধু করবেন না, স্বৈরাচারের আমলে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ শুধু করবেন না, তিনি স্বৈরাচারের মূল শিকড়গুলোও উৎপাটিত করে গণতন্ত্রকে নিষ্কণ্টক করবেন। তিনি কোটা বৈষম্য দূর করবেন। শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মমুখী করে ছাত্রদের চাকরির বন্দোবস্ত করবেন এবং শেষ পর্যন্ত সারা দেশে তিনি ুবৎড় ঁহবসঢ়ষড়ুসবহঃ তৈরির জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, ইত্যাদি।
আর যদি কোনো আন্তর্জাতিক ও জাতীয় গবঃরপঁষড়ঁং উবংরমহ-এর বিষয়টি সত্য হয়, তা হলে সেই উবংরমহ-এর অন্তর্ভুক্ত শক্তি প্রত্যাশিত বিশেষ ধরনের সংস্কারগুলোই তিনি কার্যকর করবেন এবং সেজন্য যে কয়দিন তাকে ক্ষমতায় থাকতে হয় তিনি থাকবেন এবং সেসব ডিজাইনের কাজ সম্পন্ন হলে এবং সে সব কাজের স্থায়িত্ব নিশ্চিত এবং টেকসই করার পর তিনি বিদায় নেবেন।
এই ছোট্ট আলোচনার ক্ষেত্র বা পরিসর হচ্ছে অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ। রূপালী বাংলাদেশ পত্রিকার সম্পাদকের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের ধহহরাবৎংধৎু সংখ্যার জন্য একটি ছোট লেখা লিখতে হবে, যেখানে ড. ইউনূসের ঞ.ঙ.জ নির্বিশেষে অর্থনীতি ক্ষেত্রে ড. ইউনূস সরকারের এযাবৎ অর্জিত সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ণয়ই হচ্ছে লেখক হিসাবে আমার প্রধান দায়িত্ব বা চুক্তি। এর সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নও কর্তৃপক্ষ জুড়ে দিয়েছেন। সেটি হচ্ছে ইউনূস-পরবর্তী সরকার এ ক্ষেত্রে অর্থনীতিকে নিয়ে কি ধরনের চ্যালেঞ্জ বা আপদ-বিপদ, আশীর্বাদ-অভিশাপের মুখোমুখি হতে পারে সে সম্পর্কেও কিছু উল্লেখ করতে হবে। আমি পাঠককে ও সম্পাদককে আশ^স্ত করছি আমি আমার চুক্তির বাইরে যাব না।
প্রথমেই আমি ইউনূস সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন চরিত্রের কারণে তার কাছে ছাত্র-জনতার সীমিত ন্যূনতম অর্থনৈতিক প্রত্যাশাগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরব। তারপর সেক্ষেত্রে তার সাফল্য-ব্যর্থতা নির্দেশ করব। তারপর সে সবের বাইরে তার স্ব-উদ্যোগে করা বাড়তি অর্থনৈতিক সংস্কারগুলোর কথাও উল্লেখ করব। সেগুলো গোপন গবঃরপঁষড়ঁং উবংরমহ-এর অংশ হোক বা না হোক সেগুলোর সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়েও দু-একটি মতামত প্রদান করব। যেমন শেষ মুহূর্তে এসে তিনি বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য আমাাদের স্ট্র্যাটেজিক লাভজনক বন্দরগুলোকে বিদেশি কর্তৃত্বে এক গোপন চুক্তির মাধ্যমে হস্তান্তর করেছেন। আমার মতে এটি প্রত্যাশিত ছিল না। এটি তার বাড়তি নিজস্ব উদ্যোগ এবং এর ব্যর্থতা-সাফল্যোর চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আদৌ এ তাড়াহুড়ার প্রয়োজন ছিল কি? কোনো নির্দিষ্ট ডিজাইনকে বাস্তবায়নের জন্য কি শেষ মুহূর্তে করা হলো?
ড. ইউনূস সরকারের সীমিত সংস্কার উদ্যোগ ও সীমিত সাফল্য
ইউনূস সরকার ক্ষমতায় আসীন হন ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে। সম্ভবত চলে যাবেন (ংঁঢ়ঢ়ড়ংবফষু) ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ। অর্থাৎ ধরে নিচ্ছি তার স্থায়িত্বকাল হচ্ছে ১ বছর ছয় মাস। আমরা তাই ধরে নেব সীমিত সময়ে সীমিত অর্থনৈতিক প্রত্যাশা পূরণই তার কাছ থেকে করা যেতে পারে।
তাই স্বৈরাচার আমলের শেষের দিকে এসে যে অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো জ¦লন্ত আকার ধারণ করেছিল সেগুলোর যতটুকু সমাধান সম্ভব ততটুকুই তার কাছে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি। তার অন্যতম উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিনের ভাষায় আমরা গতানুগতিক বাজেট পেশের পাশাপাশি বাজেট পলিসিতে এমন কিছু অভিনব নতুন কর্মসূচি যোগ করব যেগুলো ভবিষ্যৎ সরকারের জন্য ঋড়ড়ঃ চৎরহঃ হিসাবে টিকে থাকবে। গত বাজেটের সকল ধরনের কর্মসূচিগুলোকে যদি আমরা খতিয়ে দেখি তা হলে আমরা সহজেই দেখতে পাব যে সেখানে ওই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে কোনো আকর্ষণীয় ঋড়ড়ঃ চৎরহঃ তৈরি করা হয়নি, হয়েছে গতানুগতিক প্রচেষ্টা মাত্র। এমনকি অতীত ঐতিহাসিক মাত্রা থেকেও কম।
প্রথমত, প্রবৃদ্ধি হার কোভিডের পরই অতীতে কমতে থাকে। ৫ শতাংশ থেকে তা ৪ শতাংশে নেমে আসে। সেটা উদ্ধার করার জন্য দ্রুত প্রচুর স্ফীতিমূলক বিনিয়োগ দরকার ছিল। বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির সম্ভাবনা খুবই কম ছিল। সরকারি বিনিয়োগ তাই প্রচুর বাড়ানো উচিত ছিল। সে জন্য উপযুক্ত রাজস্ব নীতি ও মুদ্রা নীতি প্রণয়ন করে, ব্যাংকগুলোর সংস্কার করে উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ ত্বরান্বিতকরণ এবং সর্বোপরি টাকা পাচার ও ঋণ খেলাপি কমানোই ছিল ইউনূস সরকারের প্রধান কর্তব্য ও প্রধান প্রত্যাশা। আমার মতে এটুকু প্রত্যাশাই ছিল ন্যূনতম ও স্বাভাবিক প্রত্যাশা।
কথায় বলে বৃক্ষের পরিচয় ফলে। আমরা আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরও প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা ৩ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যেই আটকে আছি (বিশ^ব্যাংকসহ বেসরকারি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন সিপিডি ও সানেমের হিসাব দ্র.)। সুতরাং এক্ষেত্রে শুধু প্রবৃদ্ধির নি¤œগতি ঠেকানো যায়নি তা নয়, উপরন্তু নি¤œতর প্রবৃদ্ধির আশঙ্কাই ভবিষ্যতের সরকারের জন্য বড় ঈযধষষবহমব হিসাবে রেখে যাচ্ছেন ড. ইউনূস সরকার। তবে কেউ কেউ বলছেন যদি নির্বাচিত একটি স্থিতিশীল সরকার তৈরি হয় তখন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ ত্বরান্বিত হবে এবং তখন প্রবৃদ্ধির হার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু এটা নির্ভর করবে নির্বাচন-উত্তর সরকারটি কতখানি সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে তার ওপর। যদি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হয় এবং রাজনৈতিক গোলযোগ শুরু হয়ে যায় তা হলে স্থিতিশীলতা নাও অর্জিত হতে পারে। প্রবৃদ্ধিও নাও বাড়তে পারে।
দ্বিতীয় যেসব প্রত্যাশা স্বাভাবিকভাবে থাকে যেমন দ্রব্যমূল্য হ্রাস, টাকার মান পুনরুদ্ধার। বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণ বৃদ্ধি, ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে ফলাফল অবশ্য অবিমিশ্র খারাপ নয়। কিছু ভালো কিছু মন্দ।
আমরা দেখি শুধু জনগণ নয়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরাও এ ধরনের মিশ্র অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন। মেট্রোপলিটান চেম্বার অব কমার্সের ভাষ্য হচ্ছে ২০২৫ সালে অর্থনীতির কোনো কোনো সূচকের নি¤œগামিতা থমকে দাঁড়ালেও প্রয়োজনীয় ঊর্ধ্বগামিতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তারা বলছেন মার্চ ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। জানুযারি ২০২৫-এ এসে সেটা ৯ দশমিক ৯৪-এ পরিণত হয়। তবে তারা আশা করেন যে সেটা মার্চ নাগাদ ৯ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসবে। যেটা মূল কথা তা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ৯ শতাংশের আশপাশে এটা স্থির হয়ে আছে আর প্রধান খাদ্য চালের দামও উচ্চ মাত্রায় গিয়ে স্থির হয়ে আছে। সরকার এ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত বাজার বিক্রয়ের নীতি গ্রহণ করে ট্রাক থেকে সময় সময় কম মূল্যে বাজারে নিত্যপণ্য সরবরাহ করতে চেষ্টা করেছে, সিন্ডিকেট ভাঙার কথা বলেছে, আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করার নীতি গ্রহণ করেছে, দোকানে প্রাইস লিস্ট টাঙানোর কথা বলেছে, কিন্তু সর্বসাকুল্যে এসব অপ্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক কৌশল ফলপ্রসূ হয়নি।
এন.জি.ও মহল (বা নাগরিক কোয়ালিশন), ট্রেড ইউনিয়নগুলো বা বাম দলগুলো যেসব র্যাডিক্যাল কৌশলের প্রস্তাব দিয়েছিলেন যেমন নিত্য প্রয়োজনীয় কতিপয় খাদ্যপণ্যের জন্য আইনগতভাবে ভোক্তা অধিকার আইন তৈরি করে সরকারি দায়িত্বে সেসব নিত্যপণ্যের বণ্টনের ব্যবস্থা করা বা ভোক্তা ও উৎপাদক সমবায়ের মাধ্যমে মধ্যস্বত্ব¡ভোগীদের উঠিয়ে দেওয়া, দরিদ্র লোকদের জন্য রেশন বা খাদ্য-প্যাকেট নিয়মিত ইন্টারভালে সরবরাহের ব্যবস্থা করা, সে রকম কোনো মৌলিক পদক্ষেপ এ সরকারের পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়নি। সামান্য টোকেন ঋড়ড়ঃ চৎরহঃ মূলক কর্মসূচি রেখে যাও-বা যতটুকু সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়েছে তাতে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তবে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি এ সময় সরকারকে কিছুটা বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। ব্যবসায়ীদের সংস্থা মেট্রোপলিটান চেম্বারের মতে এ সময় নান প্রতিকূলতা (ট্রাম্পের প্রতিকূল নীতি) সত্ত্বেও রপ্তানির ক্ষেত্রে আশঙ্কাজনক কোনো কিছু হয়নি। বার্ষিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ১২ দশমিক ৫ শতাংশে মোটামুটি স্থির থাকে।
অন্যদিকে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রেরণের কারণে মোট রেমিট্যান্সের রেকর্ডেড অন্তঃপ্রবাহ দ্রুত বেড়ে যায় এবং ডলার রিজার্ভের আয়তন যতটুকু পড়ে গিয়েছিল তা পুনরায় কিছুটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়। কিন্তু এর জন্য টাকার মান ধাপে ধাপে অনেক কমাতে হয়েছে এবং অবশেষে আইএমএফ থেকে প্রতিকূল শর্তে টাকা ধার করতে হয়েছে। মুদ্রামান বাজারের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হয়েছে। তাতে অন্যদিকে আমদানির খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। তবে ঈদ উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্য থেকে এবার রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রাপ্তি সম্ভব হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আমদানি-রপ্তানি ভারসাম্যও কিছুটা উন্নতি অর্জনে সরকার সক্ষম হয়েছে। এটা সরকারের ইতিবাচক কর্মকুশলতা। কিন্তু এজন্য ক্রমাগত সরকারি ঋণ বেড়ে গেছে এবং সুদাসল পরিশোধের চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সরকারি উন্নয়ন ব্যয় ও অনেক মেগাপ্রকল্প কাটছাঁট করতে হয়েছে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এ ধরনের ব্যয় সংকোচন নীতির দ্বারা উন্নতির ফলে অন্যদিকে যে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, বেকারত্ব বাড়ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে, অসাম্যও বাড়ছে, শিল্প-কারখানা ও সেবা খাতে ছাঁটাই হচ্ছে, সে দিকটি তুলে ধরেছেন। তাদের সমালোচনা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে অর্থনীতির মূলও প্রধান লক্ষণটি ছিল : মন্দা ও মূল্যস্ফীতির সহবস্থান। সহজভাবে অর্থনীতির ঞবীঃ অনুযায়ী এই ম্যাক্রো বা সামষ্টিক অবস্থাকে চিহ্নিত করা হয় ঝঃধমভষধঃরড়হ বা মন্দাস্ফীতি হিসাবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন সেখানেই আটকে আছে।
তদুপরি এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে আগামী দু মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি নাগাদ এ অবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা টাকাওয়ালাদের প্রতিনিধিত্ব করেন, ও সক্ষমতা রাখেন তারা মাঠে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে এবার যখন তারা অর্থ বিনিয়োগ করা শুরু করবেন তখন মাইক্রো অর্থনীতিতে কিছু প্রাণসঞ্চার হতে পারে। তবে এ আশঙ্কাও আছে যে টাকার খেলার সঙ্গে সঙ্গে যদি পেশিশক্তির খেলাও শুরু হয় তা হলে প্রাণসঞ্চার না হয়ে প্রাণঘাতী প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘটনাও ঘটতে পারে। সুতরাং বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতিও ঘটতে পারে। তাই অর্থনীতি ও রাজনীতির তরল এক অনিশ্চিত অবস্থায় আমরা বর্তমানে ঝুলে আছি।
কাঠামোগত পদক্ষেপ এবং দারিদ্র্য হ্রাস-বৈষম্য হ্রাস সম্ভব হয়নি
সর্বশেষে এই কথা বলে এই লেখা শেষ করব যে এ ধরনের অন্তর্বর্তীকালীন অনির্বাচিত সরকারের পক্ষে কোনো মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার সম্ভব হয় না। এমনকি তারা যদি ধনীদের ওপর কর বসিয়ে সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টন করতেও চান অথবা ঋণপ্রবাহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার দিকে পরিচালিত করতেও চান তা হলেও তাকে প্রথমেই করের বিন্যাস ও ঋণের বিন্যাস বদলাতে হবে। আর সেটা বদলানোর জন্য একই সঙ্গে দক্ষতা যোগ্যতা ও সক্ষমতা বিচার করে ধনীদের বঞ্চিত করে নিচের উৎপাদনশীল এজেন্টদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে, যেসব ক্ষমতা কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করতে হবে তার জন্য চাই শক্ত কঠিন অঙ্গীকার, আত্মত্যাগ, সাহস ও রাজনৈতিক গণসম্পৃক্তি ও সর্বোপরি সংগঠিতও সচেতন গণঅভিযান পরিচালনার সক্ষমতা। এসব গুণ এই ধরনের সরকারের নেই। পরবর্তী বিকল্প রাজনৈতিক সরকারেরও কতটুকু থাকবে তা বলাও মুশকিল। তবে তারা নির্বাচকমন্ডলীর কাছে কিছুটা হলেও জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। তাই তাদের বা পরবর্তী সরকারের কাছে এসব মৌলিক পরিবর্তন প্রত্যাশা করাও ঠিক নয় এবং না হওয়ার জন্য দুঃখ প্রকশও বোকামি।
দুইটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রথমত, এই সরকার রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর জন্য অনেক তোড়জোড় করে নেমেছিল, প্রস্তাব বা ঘোষণাও দিয়েছিল, বৃহৎ ব্যবসায়ী ও আমলাতন্ত্রের চাপে আবার সুড়-সুড় করে পিছিয়েও এসেছে। দ্বিতীয়ত, ব্যাংক সংস্কার ও পাচার করা টাকা ফেরত আনার জন্য অনেক উচ্চ সংখ্যাতত্ত্ব প্রণয়ন করে তা ফেরতের জন্য দুদককে বা ঋরহধহপরধষ ওহঃবষষরমবহপব-কে পুনর্গঠিত ও সক্রিয় করা হয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত সমগ্র নিট ফলাফল স্পষ্ট নয়, প্রকাশিতও নয়। তবে সর্বশেষ খবরে দেখা যায়, বর্তমানে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের হার ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশে উপনীত হয়েছে! আর কয়েকটি প্রায় দেউলিয়া ব্যাংকে এই খেলাপির হার ৮৩ শতাংশ। তা হলে ফলাফল যে হতাশাব্যঞ্জক এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সুতরাং এখন জনগণের মনোভাব হচ্ছেÑ আপনারা বলেছেন অনেক বেশি কথা- করেছেন অনেক কমÑ আপাতত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিলেই আমরা খুশি।
লেখক : অর্থনীতিবিদ

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন