‘ট্যাংক থেকে নির্বিচারে গোলা বর্ষণ করা হচ্ছিল। ইসরায়েলি সেনারা স্নাইপার রাইফেল দিয়ে আমাদের গুলি করে মারছিল। মনে হচ্ছিল, তারা জঙ্গলে প্রাণী শিকারে নেমেছে’, গাজা সিটির কাশেম আবু খাতের (৩৬) জানান। তিনি এক ব্যাগ ময়দা সংগ্রহের জন্য দৌড়ে ত্রাণকেন্দ্রের দিকে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন, হাজারো ক্ষুধার্ত ও বেপরোয়া মানুষ ‘চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা ও ধাক্কাধাক্কিতে’ ব্যস্ত। ‘আমার চোখের সামনে ১৫-২০ জন মানুষ নিহত হলেন। কেউ কাউকে বাঁচাতে পারেনি।’
নাগরিক সুরক্ষা দপ্তরের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে জানান, নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে। যথারীতি ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিহতের সংখ্যা মেনে নেয়নি এবং দাবি করেছে, তারা ‘সতর্কতামূলক গুলি’ ছুঁড়েছে। সেনাবাহিনী জানায়, গাজা সিটির কাছে ‘হাজারো’ ফিলিস্তিনি জমায়েত হয়, যা তাদের প্রতি ‘তাৎক্ষণিক হুমকি’। বস্তুত বেসামরিক, নিরস্ত্র ও ক্ষুধার্ত গাজাবাসীর পক্ষ থেকে আসা এই ‘হুমকি’ দূর করতেই গুলি চালানোর দাবি করেছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের খাদ্য কর্মসূচি জানায়, তাদের ২৫টি খাদ্যবাহী ট্রাকের বহর গাজা সিটিতে এসে পৌঁছানোর পর ‘অসংখ্য বেসামরিক ক্ষুধার্ত মানুষের মুখোমুখি হয়’। এ সময় তাদের ওপর গুলি চালানো হয়।
এর অল্প সময় আগে ইসরায়েলি তল্লাশি চৌকি পেরিয়ে গাজায় প্রবেশ করে ট্রাকগুলো। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ত্রাণ নিতে আসা বেসামরিক মানুষের ওপর সহিংসতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তাদের ভাষায়, এ ধরনের কাজ ‘একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি জানান, উত্তরের পাশাপাশি দক্ষিণেও ইসরায়েলিদের গুলিতে ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজায় গণমাধ্যমের প্রবেশে বিধিনিষেধ থাকায় এএফপি নিহতের সংখ্যা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে পারেনি। এবার নিরীহ ও বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলায় স্নাইপার রাইফেল ও ট্যাংক ব্যবহার হয়েছে।
রোববার গাজার নাগরিক সুরক্ষা দপ্তরের বরাত দিয়ে এই তথ্য জানিয়েছে এএফপি। গাজায় খাদ্যাভাব চরম আকার ধারণ করেছে। নিরুপায় হয়ে ত্রাণের লাইনে ভিড় জমাচ্ছেন হাজারো ফিলিস্তিনি। প্রায় প্রতিদিনই বেশ কিছু ত্রাণপ্রত্যাশী ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি সেনার গুলিতে নিহত হচ্ছেন। জাতিসংঘ জানিয়েছে, মে মাসের শেষভাগ থেকে শুরু করে এ মাসের শুরু পর্যন্ত ত্রাণ নিতে এসে অন্তত ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের অনেকে ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে যাওয়ার পথে নিহত হয়েছেন। গাজায় ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচির নিয়ন্ত্রণভার ইসরায়েল-আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে গঠিত সংগঠন জিএইচএফের কাছে যাওয়ার পর থেকে নিয়মিত এ ধরণের ঘটনা ঘটছে।গাজার উত্তরাঞ্চলে ট্রাকে করে আসা ত্রাণ সংগ্রহ করতে এসে অন্তত ৬৭ ফিলিস্তিনি নিহত হন। অপরদিকে, দক্ষিণে রাফার কাছে গ্লোবাল হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) অপর এক ত্রাণকেন্দ্র থেকে ত্রাণ নিতে গিয়ে আরও ছয়জন নিহত হয়েছেন।
একই জায়গায় ২৪ ঘণ্টা আগেও বেশ কয়েকজন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদিকে ইসরায়েলি বাহিনী গাজা উপত্যকার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহতে স্থল ও বিমান হামলা শুরু করেছে, যার ফলে আগেই বাস্তুচ্যুত হাজারো মানুষ আবারও নতুন করে শহরটি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। স্থানীয় সময় সোমবার (২১ জুলাই) ভোরে এ অভিযান শুরু হয়, তার কয়েক ঘণ্টা আগেই শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছয়টি আবাসিক ব্লকের বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। এই এলাকাগুলো বর্তমানে রাফাহ ও খান ইউনিস থেকে বিতাড়িত হাজার হাজার শরণার্থীতে পরিপূর্ণ। স্থানীয় সাংবাদিকদের বরাতে জানা যায়, ইসরায়েলি ট্যাংক ও সামরিক যানগুলো কিসুফিম চেকপয়েন্ট দিয়ে শহরে ঢুকে পড়ে এবং ভারী কামান ও বিমান হামলার মাধ্যমে আক্রমণ চালানো হয়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, আবু আল-আজিন ও হিকার আল-জামি এলাকাগুলোতে ডজনখানেক গোলা বর্ষণ করা হয় এবং একই সময়ে স্থলবাহিনী অগ্রসর হয়। গাজা যুদ্ধের বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন পোপ লিও চতুর্দশ। একই সঙ্গে তিনি শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন। গাজার এই শহরটিতে দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস ও রাফা থেকে আসা হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়ে আছেন। ফিলিস্তিনি ছিটমহল গাজার মধ্যাঞ্চলীয় শহর দেইর আল-বালাহে স্থল অভিযান ও বিমান হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গাজায় ২১ মাস ধরে চলা যুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনী এর আগে শহরটিতে কোনো স্থল অভিযান চালায়নি বলে বিবিসি জানিয়েছে। গাজার এই শহরটিতে ও এর আশপাশের এলাকাগুলো দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস ও রাফা থেকে আসা হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়ে আছেন।
গাজায় বিতর্কিত ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফের একটি ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে জড়ো হওয়া ক্ষুধার্ত ও অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়েছেন ইসরায়েলি সেনারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। আলজাজিরার ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা সানাদ ২০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেছে। এতে দেখা গেছে, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের রাফা শহরের শাকুশ এলাকায় ইসরায়েলি সেনারা মরিচের গুঁড়ার স্প্রে ব্যবহার করে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করছেন। মুঠোফোনে ভিডিওটি ১০ জুলাই ধারণ করা হয়। শনিবার রাতে ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, তিনজন সশস্ত্র ইসরায়েলি সেনা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রে ফিলিস্তিনিদের ওপর মরিচের গুঁড়া ছুড়ছেন। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা সানাদ ২০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওর সত্যতা যাচাই করেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখ-ে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস। গাজার প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা সংগঠনের হামলায় এক হাজার ২১৯ জন নিহত হন। সেদিনই গাজায় প্রতিশোধমূলক, নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত এই সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৫৮ হাজার ৮৯৫ ফিলিস্তিনি। তাদের বেশির ভাগই বেসামরিক মানুষ। ৬০ দিনের সম্ভাব্য যুদ্ধবিরতি নিয়ে কাতারের মধ্যস্থতায় হামাস-ইসরায়েলের বৈঠক চলছে। তবে ওই উদ্যোগে অগ্রগতি নেই। অপরদিকে, দেইর আল-বালাহ এলাকায় সামরিক অভিযান সম্প্রসারণের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েলি সেনা। এতে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।