ইসরায়েলি সেনারা শুক্রবার থেকে গাজা সিটিতে ‘ভয়াবহ হামলার প্রস্তুতিমূলক অভিযান’ শুরু করেছে। সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জনবহুল এ নগরীকে ‘বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ ঘোষণা করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আভিখাই আদরেই মার্কিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক বিবৃতিতে জানান, পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের নির্দেশনার ভিত্তিতে সকাল ১০টা থেকে গাজা সিটিতে সেনা কার্যক্রমের সাময়িক মানবিক বিরতি আর কার্যকর হবে না। নগরীটিকে এখন থেকে বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তিনি আরও দাবি করেন, সেনাবাহিনী ‘সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর’ বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখবে, একই সঙ্গে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমেও সহযোগিতা করবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আনাদোলুকে জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল থেকেই শহরের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ শুরু হয়। আবাসিক এলাকায় কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা গেছে। স্থানীয়রা জানান, ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান টানা উড্ডয়ন করেছে এবং আল-কারামা, আল-সাফতাওয়ি, আবু ইস্কান্দার, আল-জাল্লা সড়কের শেষ প্রান্ত ও ইন্টেলিজেন্স টাওয়ার এলাকায় একের পর এক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা- ঘটেছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) সতর্ক করে বলেছে, গাজা সিটিতে সামরিক অভিযান তীব্রতর হলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ আবারও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। সংস্থাটি আরও যোগ করেছে, অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ইতিমধ্যেই নিশ্চিত হয়েছে। নতুন করে হামলা হলে মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র হবে। গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় ২৩ জন ত্রাণপ্রার্থীসহ কমপক্ষে ৫৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় নিহতের সংখ্যা ৬৩ হাজার ২৫ জনে দাঁড়িয়েছে। শুক্রবার (২৯ আগস্ট) গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২২৪ ফিলিস্তিনি আহত হয়েছে। এ নিয়ে মোট আহতের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৫৯ হাজার ৪৯০ জনে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার আল-জাইতুন এলাকায় তীব্র সংঘর্ষের মধ্যে এক ইসরায়েলি সেনা নিহত ও ১১ জন আহত হয়েছে। পাশাপাশি চারজন সেনা নিখোঁজ রয়েছে। আল-কাসাম ব্রিগেডস সতর্ক করেছে যে সেনারা মৃত্যু বা বন্দি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা এলাকাটি ‘বিপজ্জনক যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং সংবাদ প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। শনিবার (৩০ আগস্ট) রোয়া নিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংঘর্ষটি গাজার আল-জাইতুন এলাকায় ঘটেছে। সংঘর্ষের সঙ্গে বিমান হামলা ও গোলাবর্ষণ রয়েছে। ইসরায়েলি সেনারা শহর দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। চ্যানেল আই২৪ জানিয়েছে, সেনারা এলাকায় প্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে, যা গত ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে সবচেয়ে মারাত্মক লড়াই হিসেবে চিহ্নিত।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেনাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেও তা সরকারিভাবে নিশ্চিত হয়নি। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী নিখোঁজ সৈন্যদের সন্ধানে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে। আল-কাসাম ব্রিগেডস তাদের টেলিগ্রাম চ্যানেলে সতর্ক করেছে, ‘যারা ভুলে যান তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, মৃত্যু বা বন্দিত্ব।’ ভিডিও ফুটেজ অনুযায়ী, হেলিকপ্টার এবং যুদ্ধের শব্দ থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে সেনারা ‘হানিবাল প্রোটোকল’ সক্রিয় করতে পারে, যা সেনা বন্দি হওয়া রোধ করার জন্য একটি বিতর্কিত নীতি। বৃহস্পতিবার হামাসের সামরিক শাখা আল-কাসাম ব্রিগেডসের মুখপাত্র আবু ওবেইদা বলেছেন, গাজার দখল ইসরায়েলের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতিতে সেনাদের বন্দি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তিনি আরও জানিয়েছেন, ইসরায়েলের হামলায় বন্দিরা নিহত হলে তাদের নাম, ছবি এবং মৃত্যুসনদ প্রকাশ করা হবে। ইসরায়েলের বর্তমান হামলা ‘অপারেশন গিডিওন ২’-এর অংশ। এটি ২১ আগস্ট প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল ক্যাটজ অনুমোদন করেছেন।
অভিযান শুরু হয় আল-জাইতুন এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, পরে তা সাবরা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। বৃহস্পতিবার থেকে বোমাবর্ষণ আরও তীব্র হয়েছে। উল্লেখ্য, ইসরায়েল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় হামলা চালিয়ে ৬৩,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। সামরিক অভিযান উপত্যকাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে এবং খাদ্যসংকট তৈরি করেছে। গত নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এ ছাড়া ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখি। তথ্যসূত্র: আনাদোলু এজেন্সি। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরায়েলের পরিকল্পিত সামরিক হামলা ও ভারী বোমাবর্ষণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে এই অভিযান মানবিক বিপর্যয় এবং ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি ডেকে আনতে পারে। একই সময়ে, ইসরায়েল দাবি করেছে যে তারা গাজায় আইএসের (ওঝওঝ) শীর্ষ নেতা মুহাম্মদ আবদ আল-আজিজ আবু জুবাইদাকে হত্যা করেছে। শনিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ক্রমেই তীব্র হচ্ছে।
শনিবার ভোরে গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালানো হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনী পরিকল্পিতভাবে গাজা দখলের অগ্রগতি জানিয়েছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সংস্থা সতর্ক করেছে যে প্রায় দশ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। বুরেইজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ইসরায়েল দাবি করেছে যে তারা মুহাম্মদ আবদ আল-আজিজ আবু জুবাইদাকে হত্যা করেছে, যিনি গাজায় আইএস-এর শীর্ষ নেতা ছিলেন এবং অস্ত্র, তহবিল সরবরাহ ও সামরিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করতেন। উল্লেখ্য, ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত গাজায় অন্তত ৬৩,০২৫ জন নিহত এবং ১,৫৯,৪৯০ জন আহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে যে তারা আগামী মাসে জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত বিশ্বনেতাদের সম্মেলনে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে নিউ ইয়র্ক সফরের অনুমতি দেবে না। জাতিসংঘের সতর্কবার্তা অনুযায়ী, এই অভিযান মানবিক বিপর্যয় এবং বৃহৎ বাস্তুচ্যুতির ঝুঁকি তৈরি করছে। গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলা সাধারণ মানুষের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে, বিশেষত নারী ও শিশুদের দুর্দশা অব্যাহত রয়েছে। শনিবার (৩০ আগস্ট) আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজা সিটির জেইতুন এলাকায় হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলি সৈন্যদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। তীব্র গুলিবর্ষণের মধ্যে সৈন্যদের সরিয়ে নিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার পাঠিয়েছে। সেখানে থেমে থেমে যুদ্ধ হয়। সর্বশেষ পরিস্থিতি এখনো অজানা।