‘কখনো কল্পনাও করিনি যে আমি তাঁবুতে থাকব, সেখানে কাজ করব। পানি ও বাথরুমের মতো মৌলিক চাহিদা থেকে আমাকে বঞ্চিত থাকতে হবে। এটা (তাঁবু) গ্রীষ্মকালে গ্রিনহাউসের মতো এবং শীতকালে রেফ্রিজারেটরের মতো কাজ করে,’ বিবিসিকে বলেছেন সাংবাদিক আবদুল্লাহ মিকদাদ। গাজা উপত্যকায় সাংবাদিকরা বিভিন্ন হাসপাতালের আশপাশে কাপড় এবং প্লাস্টিকে মোড়া তাঁবুতে কাজ করেন এবং সেখানেই ঘুমান। কাজের জন্য সারাক্ষণ বিদ্যুৎ এবং নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেসের প্রয়োজন হয় সাংবাদিকদের। অথচ গাজায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তাই হাসপাতালের কাছাকাছি থাকতে বাধ্য হন তারা, যেখানে জেনারেটর এখনো কাজ করছে। সেখানে নিজেদের ফোন এবং সরঞ্জাম চার্জ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ পান তারা।
বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমকে যেন সাংবাদিকতার দীক্ষা দিচ্ছেন গাজার সংবাদকর্মীরা। যাদের সাহসিকতাকে কোনো ভাষা দিয়েই মূল্যায়ন করা যায় না। একের পর এক সহকর্মী ইসরায়েলের টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হওয়ার পরও থামতে রাজি নন গাজার সাংবাদিকরা। গত রোববার নিহত ৫ সংবাদকর্মীর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাও ঘোষণা দিয়েছে, গাজায় কার্যক্রম বন্ধ করবে না তারা। ইসরায়েলি হামলায় আহত আরও একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক গতকাল সোমবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। এর আগে রোববারের হামলায় আলজাজিরার পাঁচজন সংবাদকর্মী নিহত হয়েছিলেন। এ নিয়ে গাজায় ২৪৭ সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
বিশ্বের সব যুদ্ধই সব সময় সংবাদ সংগ্রহের কাজটিকে বিপজ্জনক করে তোলে। তবে আধুনিক সংঘাতগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় সাংবাদিকদের জন্য যে মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা তুলনাহীন। এ ভূখ-ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২৪৭ জন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী। আধুনিক ইতিহাসে গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য এটি এক নজিরবিহীন কালো অধ্যায়ই বলা যায়। নিহতদের সিংহভাগই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষক সংস্থা ‘কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস’ (সিপিজে) জানায়, ১৯৯২ সালে সাংবাদিক মৃত্যুর রেকর্ড রাখা শুরু করার পর গত দুই বছরই ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী সময়। তবে, এ নিহত সাংবাদিকদের প্রায় সবাই ফিলিস্তিনি।
এর মূল কারণ হলো, ইসরায়েল কোনো বিদেশি সাংবাদিককে গাজায় ঢুকতে দেয়নি। গাজায় বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের প্রবেশে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞা কেবল নিন্দনীয়ই নয়, বরং তাদের জন্য একটি আত্মঘাতী পদক্ষেপও। আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না দেওয়ার এ সিদ্ধান্ত ইসরায়েলি সরকারকে এমন একটি মানদ- থেকে বিচ্যুত করেছে, যা অনেক সরকার, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক দেশগুলো মেনে চলে। আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছিল। একইভাবে, ইউক্রেনও রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে বিদেশি সাংবাদিকদের কভারেজের সুযোগ দিয়েছে।
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নিতে অভিযান জোরদার করেছে ইসরায়েলি সেনারা। উপত্যকাটিতে সারা দিনে গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় শিশু ও সাংবাদিকসহ অন্তত ৭৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩২ জনই খাদ্য সহায়তাপ্রার্থী। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরও অনেকে।
গতকাল সোমবার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণে জোরপূর্বক সরিয়ে দিতে অভিযান জোরদার করেছে ইসরায়েল। গত রোববার ভোর থেকে সারা গাজা উপত্যকায় অন্তত ৭৮ জন নিহত হয়েছেন, এর মধ্যে ৩২ জন খাদ্য সংগ্রহে বের হয়েছিলেন।
গাজায় সাংবাদিকদের মৃত্যুর সমালোচনায় ইসরায়েল দাবি করছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হামাসের এজেন্ট। কিছু সংবাদমাধ্যমকর্মী হামাস বা ইসলামিক জিহাদের সঙ্গে যুক্ত বলেও তারা উল্লেখ করে। কিন্তু ইসরায়েলের এ অভিযোগ, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাহসী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে, যারা প্রায় অসম্ভব পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন, তাদের হামাসের যোদ্ধা হিসেবে আখ্যায়িত করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। ইসরায়েল তাদের এ দাবি প্রমাণেও ব্যর্থ।
ফিলিস্তিনের গাজা নগরীর উপকণ্ঠে তীব্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। এবার তারা গাজা নগরীর কেন্দ্রের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। গত শনিবার রাতে সেখানে বিমান হামলার পাশাপাশি স্থল হামলাও চালানো হয়। এতে সেখানকার বহু বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। হামলার মুখে অনেক পরিবার এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
গাজার স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইসরায়েলি গুলি ও বিমান হামলায় গত সোমবার অন্তত ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১৩ জন একটি ত্রাণকেন্দ্রের কাছে খাবারের জন্য যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। দুজন নিহত হয়েছেন একটি বাড়িতে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রের কার্যালয় জানিয়েছে, তারা এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করছে। গাজা নগরীর উপকণ্ঠে বসবাসকারী শেখ রাদওয়ান বলেন, ইসরায়েলি ট্যাংকের গোলাবর্ষণের মুখে পড়েছে ওই এলাকা। শনিবার থেকে সেখানে বিমান হামলার মধ্যেই ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করা হচ্ছে। এতে লোকজন বাধ্য হয়ে পালিয়ে শহরের পশ্চিমাঞ্চলে চলে যাচ্ছেন।তিন সপ্তাহ ধরে গাজা নগরী ঘিরে ধীরে ধীরে হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। শুক্রবার থেকে ত্রাণ বিতরণ এলাকাগুলোতেও হামলা করছে তারা।ইসরায়েলের এক সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, নেতানিয়াহুর নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার রোববার গাজা নগরীর হামলা নিয়ে বৈঠক করার কথা। কয়েক সপ্তাহ ধরে হামলার তীব্রতা বাড়ালেও এখনো একসঙ্গে পুরোপুরি স্থল হামলা শুরু করেনি ইসরায়েল। তারা বলছে, জনগণকে সেরে যেতে তারা সময় দিচ্ছে।
গাজায় হামাসের সামরিক প্রধান মোহাম্মদ সিনওয়ার নিহত হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছে সংগঠনটি। শনিবার হামাসের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। গত মে মাসে ইসরায়েল জানিয়েছিল যে তাদের সেনা অভিযানে মোহাম্মদ সিনওয়ার নিহত হয়েছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন