দিনকে দিন গাজার পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। বিশেষ করে গাজা সিটিতে একের পর এক বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। সেই সঙ্গে বাড়ছে গোলাবর্ষণের মাত্রা। আলজাজিরার প্রতিবেদক জানিয়েছেন, তুফাহ, শুজাইয়া, শেখ রাদওয়ান আর রিমাল এলাকার আকাশজুড়ে এখন শুধু বোমার শব্দ আর ড্রোনের গর্জন। জানান এমনও দৃশ্য দেখা গেছে যেখানে শেখ রাদওয়ানের এক ক্লিনিকের সামনে দাঁড়ানো অ্যাম্বুলেন্সে ইসরায়েলি ড্রোন থেকে সরাসরি বোমা ফেলা হয়েছে। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণ ও হামলার মধ্যে ফিলিস্তিনিরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেষ বার্তা ও বিদায় চিঠি লিখে রাখছেন। তাদের আশঙ্কা, এবার তারা বাঁচবেন না।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের হামলা শুরুর পর থেকেই গাজাবাসী একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে, ইসরায়েলের আক্রমণ ও তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কথা বিশ্ববাসীকে জানাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু গত ২৪ ঘণ্টায় হতাশা ও মৃত্যুভয় নিয়ে লেখা পোস্টের সংখ্যা বেড়েছে। গাজার এক নারী নূরের পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া একটি এলাকায় পাশের ভবনে ইসরায়েলি হামলা হচ্ছে। ভিডিওটির পটভূমিতে এক নারীর কান্নার শোনা যায়। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা, ‘এবার মনে হচ্ছে আমরা বাঁচবো না...’। গতকাল বুধবারের রিয়াল নিউজ নেটওয়ার্কের এক প্রতিবেদনে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা তুলে ধরা হয়।
দিন যত গড়াচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী যেন আরও বেশি আগ্রাসী হচ্ছে। গতকাল বুধবারও গাজাজুড়ে চলছে তাদের বর্বরতা। সবশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, ভোর থেকে প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত উপত্যকাজুড়ে অন্তত ২০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ১৫ জনই গাজা সিটির বাসিন্দা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গলবারও শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। কাতারি সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর রাফাহতে বিতর্কিত সংগঠন গাজা হিউম্যানিটিরিয়ান ফাউন্ডেশনের ত্রাণ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে আরও তিনজন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে অনাহারে নিহত হয়েছে আরও অন্তত ৬ ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে এক শিশুও রয়েছে। এ নিয়ে অনাহার-অপুষ্টিতে গাজায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৩৬৭ জনে, যাদের মধ্যে ১৩১ জনই শিশু।
গাজা সিটিতে ইসরায়েলি হামলায় নারী-শিশু ও সাংবাদিকসহ কমপক্ষে আরও ১০৫ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ত্রাণের সন্ধানে থাকা বহু মানুষ রয়েছেন। গতকাল আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শুধু গাজা সিটির আল-সাবরা মহল্লাতেই কয়েক দিন ধরে চলা হামলায় বহু মানুষ নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৩২ জন ছিলেন ত্রাণসন্ধানী। আলজাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খৌদারি জানিয়েছেন, গাজা সিটিতে এখন মানুষ একরকম খাঁচায় বন্দি। বোমা হামলা থেকে বাঁচতে তারা যেখানেই যায় হামলা যেন তাদের অনুসরণ করছে।
একই সঙ্গে খাদ্য ও ত্রাণের অভাবে মানুষ অনাহারে মরছে। গত ২৪ ঘণ্টায় অনাহারে মারা গেছেন আরও ১৩ জন। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত অনাহারে মারা গেছে ৩৬১ জন। গত মঙ্গলবার দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসের কাছে আল-মাওয়াসি এলাকায় পানির লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত ২১ জনকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েল। নিহতদের মধ্যে ছিলেন ৭ শিশু। অথচ এ এলাকাকেই আগে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ ঘোষণা করেছিল ইসরায়েল।
জানা গেছে, ইসরায়েল থেকে গ্যাস আমদানি করতে নতুন পাইপলাইন নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছে মিসরের সরকার। গাজায় চলমান যুদ্ধের মধ্যে এমন একটি চুক্তি এরই মধ্যে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। পাইপলাইন নির্মাণ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কিছু মিডিয়া বলছে, আগামী বছরের শুরুতে এর নির্মাণকাজ শুরু হবে। আবার চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকেই পাইপলাইনের কাজ শুরু হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। ইসরায়েলের নিউমেড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির আওতায় এই পাইপলাইন নির্মাণ করা হবে। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ থেকে ২০৪০ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের লেভিয়াথান ফিল্ড থেকে ১৩০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস আমদানি করবে মিসর।
ফিলিস্তিনের গাজায় গত আগস্ট মাসে অপুষ্টিতে ১৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলের অবরোধের কারণে অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সবশেষ গত ২৪ ঘণ্টায় অপুষ্টিতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১৩ জনের। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, জাতিসংঘের বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা দ্য ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) গত মাসের শেষ সপ্তাহে গাজার কিছু অংশে পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ চলছে বলে ঘোষণা দেয়। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ৮৩ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৫ শিশু রয়েছে। গাজায় পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪৩ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে বলেও উল্লেখ করা হয় বিবৃতিতে। ৫৫ হাজারেরও বেশি অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী নারীও একই সমস্যায় ভুগছেন। এ ছাড়া নারী অন্তঃসত্ত্বা নারীদের দুই-তৃতীয়াংশ ভুগছেন রক্তশূন্যতায়।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন