গাজা উপত্যকা। যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাসই যেন আজ টিকে থাকার এক করুণ সংগ্রাম। প্রথম থেকেই এই যুদ্ধের সবচেয়ে নীরব আর নিষ্পাপ শিকার শিশুরা। অপুষ্টি, তৃষ্ণা আর শৈত্যপ্রবাহের আশঙ্কা তাদের ছোট্ট শরীরে আগুনের মতো নেমে আসছে। তবে এবার তাদের সাথে শামিল হয়েছেন বয়স্করাও। সব মিলিয়ে ক্ষুধা এখন শুধু একটা শব্দ নয়, গাজা উপত্যকায় এটি এখন মৃত্যু ঘনিয়ে আনার আরেক নাম। ইসরায়েলি অবরোধ আর নিষ্ঠুরতার এই দীর্ঘ কালো রাতের শেষ কোথায় তা জানে না কেউ। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, গাজার মাটিতে প্রতিটি ফোঁটা রক্ত, প্রতিটি কান্না ইতিহাস হয়ে থাকবে, মানবতার ব্যর্থতার এক নীরব সাক্ষী হয়ে। চলমান ইসরায়েলি গণহত্যার মধ্যে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ১৪৫ জন শিশুসহ ৪২৫ জন ফিলিস্তিনি ক্ষুধায় মারা গেছেন।
সোমবার স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দিনেই গাজায় অনাহারে ৩ জনের মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে। মঙ্গলবার ভোর থেকে গাজাজুড়ে ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ৬২ জন নিহত হয়েছে। ইসরায়েলের নির্মম অবরোধে ফিলিস্তিনিরা যেন জীবন্ত কবরের মাঝে আটকে পড়া আত্মা। ক্ষুধার করালগ্রাসে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে একটি প্রজন্ম। কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দৃশ্য হলো, অপুষ্টিতে কঙ্কালসার শিশুগুলো আর কাঁদতেও পারছে না। অপুষ্টি তাদের হাড় গিলে খেয়েছে, ক্ষুধা যেন তাদের শ্বাস থামিয়ে দিয়েছে। ফিলিস্তিনি শিশুরাই শুধু নয়, বয়স্করাও ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদছে।
এ যেন মানবতার চরম পরাজয়ের চিত্র! গাজায় মৃত্যুর কারণ আর বোমা নয়, এখন মৃত্যু আসছে খিদের ছুরিতে। ইসরায়েলি অবরোধ শুধু গাজাকে আটকে দেয়নি, তারা থামিয়ে দিয়েছে খাবার, পানি, ওষুধ, থামিয়ে দিয়েছে মানবতার ন্যূনতম অধিকার। আর তাই গাজায় প্রতিদিন বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা, আর সেই সঙ্গে বাড়ছে লাশের মিছিল। বয়স্করাও আর সহ্য করতে পারছে না। একজন পিতা, যিনি নিজের ছেলে-মেয়েকে একসময় বুকে নিয়ে ঘুম পাড়াতেন, আজ তিনি নিজেই ক্ষুধায় বাচ্চার মতো কাঁদছেন।
মৃত্যু আর ক্ষুধার এই অমানবিক প্রতিযোগিতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪২২ জন! আলজাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ সেপ্টেম্বর মাত্র ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৫৩ ফিলিস্তিনি। গাজা সিটির বুক চিরে ধসে পড়েছে ১৬টি ভবন। তিনটি ছিল মানুষের বসবাসের শেষ আশ্রয়। এসব ধ্বংস শুধু ইট-পাথরের ওপর নয়, সরাসরি মানবতার ওপর চালানো আঘাত। উত্তর গাজার জনগণকে উচ্ছেদ করতে চালানো এই নিষ্ঠুর আক্রমণের ফাঁকেই ক্ষুধা আর অপুষ্টিতে নিঃশেষ হলো আরও দুইটি জীবন। একদিকে বোমা, অন্যদিকে অভুক্তের মৃত্যু, গাজা যেন ধ্বংস আর হাহাকারের এক ভয়াবহ প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
এদিকে, অবিরাম হামলায় পরিবারগুলো আবারও দক্ষিণাঞ্চলের আল-মাওয়াসির দিকে পালাচ্ছে। তবে যে আল-মাওয়াসিরকে বলা হয়েছিল নিরাপদ, সেই জায়গায় নেই পানি, নেই টয়লেট, নেই মাথা গোঁজার ঠাঁই। খোলা আকাশই এখন ছাদের নামান্তর। শিশুদের চোখে ঘুম নেই, পেটে খাবার নেই, কাঁধে ক্লান্তি আর অনিশ্চয়তার বোঝা। অপুষ্টিতে কাবু ছোট ছোট শিশুগুলোকে ঠা-া থেকে বাঁচাতে সবাই তাকিয়ে আছেন একটি নতুন তাঁবুর আশায়। কারণ, আসন্ন শীত যে আরও নির্মম, আরও ভয়াবহ!
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখ-ের সবচেয়ে বড় নগরী গাজা সিটিতে ইসরায়েলের ব্যাপক বিমান হামলায় লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। ২৪ ঘণ্টায় এই শহরে টানা বোমাবর্ষণে অন্তত ৫১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছয় বছর বয়সি যমজ শিশু এবং তিনজন সাংবাদিকও রয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) আলজাজিরার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল সোমবার সন্ধ্যায় গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালিয়ে এলাকার সর্বোচ্চ আবাসিক ভবন আল-ঘাফরি হাইরাইজ গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এই তীব্র হামলার কারণে লাখো বাসিন্দা শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। ফিলিস্তিনি ভূখ-ে মানবাধিকারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ফ্রান্সেসকা আলবানিজ অভিযোগ করেছেন যে, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উৎখাত করতে ইসরায়েল অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করছে। ইসরায়েলি টিভি চ্যানেল ১২ জানিয়েছে যে, গাজা সিটির উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে ‘অস্বাভাবিক তীব্র হামলা’ চালানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে যে, গত কয়েক সপ্তাহে ইসরায়েল অন্তত ৫০টি বহুতল ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে।
শহরের অন্যান্য এলাকাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধু জায়তুন এলাকায় আগস্টের শুরু থেকে ১ হাজার ৫০০-এর বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ টানা তৃতীয় দিনের মতো হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে লিখেছেন, ‘সন্ত্রাসের টাওয়ার সমুদ্রে ভেঙে পড়েছে।’ তবে তিনি এই ভবনটি হামাসের ব্যবহৃত ছিল এমন কোনো প্রমাণ দেননি।
গত ২৩ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে আবাসিক এলাকা, স্কুল এবং হাসপাতাল বারবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
গাজা সিটিতে গত রাতে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস এবং জেরুজালেম পোস্টের বরাতে জানা গেছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পুরো গাজা শহর দখলের লক্ষ্যে স্থল অভিযান শুরু করেছে। যদিও এই তথ্য এখনো ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হয়নি। গাজার মধ্যাঞ্চলেও ইসরায়েলি বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে। সেখানে সহস্রাধিক মানুষ নিরাপত্তার খোঁজে পালাচ্ছেন।