ঢাকা বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

সুশীলার হাতে নেপালের চাবি

একটি গেমিং অ্যাপে ঠিক হয় নেপালের প্রধানমন্ত্রী

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫, ০১:০৪ এএম

ভোট হবে। যে জিতবে, সে-ই হবে সরকারপ্রধান। গণতন্ত্রে এটাই নিয়ম। কিন্তু অভ্যুত্থানে সরকারের পতন ঘটলে? তখন এতে নেতৃত্ব দেওয়ারাই তা ঠিক করে নেন। নেপালে সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের পরও তাই ঘটেছে। তবে এতে নেতৃত্ব দেওয়া জেন-জি তা করেছে নতুন এক পদ্ধতিতে। সহিংস বিক্ষোভে কে পি শর্মা অলি পদত্যাগের পর গত বৃহস্পতিবার নেপালের হাজার হাজার তরুণ দেশের পরবর্তী নেতা বেছে নিতে এক উত্তপ্ত সভায় মিলিত হয়। তাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছিলেন মূল ধারার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হওয়ার পর নতুন সংবিধানে চালিত নেপালে ১৪টি সরকার আসে, যার সব কয়টিতে ছিল তিনটি প্রধান দলের প্রতিনিধিত্ব।

দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জেন-জির আস্থা টুটে গিয়েছিল। তারা এবার একজন সর্বসম্মত নেতা চেয়েছিল, যিনি ৩ কোটি মানুষের এই দেশটিকে বিশৃঙ্খলা থেকে বের করে আনবেন এবং দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি নির্মূলের পদক্ষেপ নেবেন। তবে নতুন নেতা নির্বাচনে পুরোনো পথে হাঁটেনি এই তরুণরা। তারা এমন একটি উপায় বেছে নিল, যা কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আগে দেখা যায়নি। একটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে তারা এই কাজটি করে, যা মূলত অনলাইন গেমাররা ব্যবহার করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের এই বিনা মূল্যের মেসেজিং অ্যাপটির নাম ডিসকর্ড। অনলাইন এই সমাবেশের আয়োজন করে জেন-জি গ্রুপ ‘হামি নেপাল’, যাতে সদস্যসংখ্যা ১ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি।

‘হামি নেপাল’ প্ল্যাটফর্মটিতে ‘ইয়ুথ অ্যাগেইনস্ট করাপশন’ নামে একটি চ্যানেল খোলা হয়, সেখানে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেয় ১০ হাজারের বেশি ব্যক্তি। তাদের মধ্যে অনেক প্রবাসীও ছিল। অনেকে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেও পারেনি বলে ইউটিউবে লাইভ স্ট্রিমিং হয় এই আলোচনার, সেখানে ৬ হাজারের বেশি ব্যক্তি তা দেখেছিল। ঘণ্টাব্যাপী এই বিতর্কে বিক্ষোভকারীদের নেতাদের কাছে কঠিন সব প্রশ্ন ছিল এবং সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীদের সঙ্গে রিয়েল-টাইমে যোগাযোগের চেষ্টাও চলে।

এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে নেপালকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কিকে বেছে নেওয়া হয়। নেপালের প্রথম নারী প্রধান বিচারপতি ৭৩ বছর বয়সি সুশীলা শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপালের এই পরিবর্তন মাত্র শুরু। বিক্ষোভকারীরা যেভাবে দেশের নেতা বেছে নিয়েছে, তা থেকে বোঝা যায় যে নতুন এক ধরনের গণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে, যার মধ্যে ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনই আছে সফলতার সম্ভাবনা। ডিসকর্ড বিতর্কের সমর্থকরা বলছেন যে, এটি রাজনীতিকদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের প্রচলিত পদ্ধতির বিরুদ্ধে একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ।

কারণ আগের পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার অভাব ছিল, যা এখানে ছিল না। ডিসকর্ড ব্যবহারকারীদের টেক্সট, ভয়েস কল, ভিডিও কল ও মিডিয়া শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে সংযুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়। এটি সরাসরি মেসেজের মাধ্যমে কমিউনিটি স্পেসগুলোতেও যোগাযোগের সুযোগ করে দেয়। নেপালের নিয়ম না মানার কারণ দেখিয়ে অলি সরকার আরও দুই ডজন জনপ্রিয় অ্যাপ যেমনÑ ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স ও ইউটিউবের সঙ্গে ডিসকর্ডকেও নিষিদ্ধ করেছিল। এই নিষেধাজ্ঞাই প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির সরকারের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণবিক্ষোভ তৈরি করে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দুর্নীতি এবং স্বজনপ্রীতি নিয়ে অসন্তোষ। গত মঙ্গলবার হাজার হাজার তরুণ রাস্তায় নেমে আসে। সরকারি ভবন, পার্লামেন্ট এবং শীর্ষ রাজনীতিকদের বাড়িতে আগুন দেয় এবং ওলিকে পদত্যাগে বাধ্য করে।

শুক্রবার প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল পার্লামেন্ট ভেঙে দেন এবং মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। মার্চ মাস পর্যন্ত কে দেশের নেতৃত্ব দেবে, তা ঠিক করতেই নেপালের জেন-জি বিক্ষোভকারীরা ডিসকর্ডে মিলিত হয়। বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের আগে অলির সরকার সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছিল। রিয়েল-টাইমে মোবাইল স্ক্রিনে ভার্চুয়াল ভোটের মাধ্যমে জেন-জিরা অন্তর্বর্তীকালীন নেতা ঠিক করে, যা ডিজিটাল গণতন্ত্রের একটি বৈপ্লবিক পরীক্ষা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সেই আলোচনায় যোগ দেওয়া ২৫ বছর বয়সি আইনের শিক্ষার্থী রেজিনা বসনেট বলেন, ‘মানুষ ঠেকে ঠেকেই শেখে। আমাদের অনেকেই জানতাম না যে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া বা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা বলতে কী বোঝায়। তাই আমরা প্রশ্ন করছিলাম, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে উত্তরও নিচ্ছিলাম এবং একই সঙ্গে সমাধান বের করার চেষ্টা করছিলাম।’ আলোচনায় নেপালের নানা সমস্যার বিষয়গুলো উঠে আসে।

যেমনÑ কর্মসংস্থান, পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার, পাশাপাশি সরকারি স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা। তবে মডারেটররা মূল প্রশ্নÑ অর্থাৎ নেতা নির্বাচনের দিকেই সবার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন। অনেক আলোচনার পর চূড়ান্ত ভোটের জন্য পাঁচটি নামের সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়েছিল। তারা হলেনÑ ধরান শহরের মেয়র, সমাজকর্মী হারকা সাম্পাং; জনপ্রিয় সমাজকর্মী মহাবীর পুন, যিনি ন্যাশনাল ইনোভেশন সেন্টার পরিচালনা করেন; নির্দলীয় রাজনীতিক সাগর ঢাকাল, যিনি ২০২২ সালে নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দিউবার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন; আইনজীবী রাষ্ট্রা বিমোচন তিমালসিনা, যিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে ‘র‌্যান্ডম নেপালি’ নামে পরিচিত এবং বিচারপতি সুশীলা কার্কি।