১০ বছর বয়সি রাশা। যখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বাড়িতে বোমাবর্ষণ করে ওকে হত্যা করে, তখন রাশার বয়স ছিল ১০, ভাই আহমেদের ১১, সে আহত হয়। ১০ বছর বয়সি বাচ্চার হইহুল্লোড় করে পাড়া মাথায় তোলার কথা। সে কেন শেষ ইচ্ছার কথা লিখে যাবে? একটা খাতার রুলটানা কাগজে নিজের শেষ ইচ্ছা লিখে গেছে মৃত্যুর আগে ১০ বছর বয়সি রাশা।
‘আমার ইচ্ছা, আমি যদি শহিদ হই বা মারা যাই, তোমরা আমার জন্য কেঁদো না। তোমরা কাঁদলে আমার কষ্ট হয়। যারা অভাবী, তাদের আমার জামাকাপড়গুলো দিয়ে দিয়ো। খেলনাগুলো ভাগ করে দিয়ো রাহাফ, সারা, জুডি, লানা আর বাতুলের মধ্যে। পুঁতির মালাগুলো দিয়ো আহমদ আর রাহাফকে। আমাকে প্রতি মাসে পকেট খরচ দিতে ৫০ শেকেল করে। সেটা রাহাফকে ২৫ আর আহমেদকে ২৫ করে ভাগ করে দিয়ো। রাহাফকে দিয়ো আমার গল্পের বইগুলো। আর তোমাদের অনুরোধ করি, আমার ভাই আহমেদকে তোমরা বকা দিয়ো না। এই ইচ্ছাগুলো তোমরা রেখো।’
সেবার রাশা আর আহমেদ বেঁচে গিয়েছিল। আরও কয়েক মাস যুদ্ধ, ভয় এবং ক্ষুধায় বেঁচে থাকবে বলেই হয়তো। রাশা তার উইলে বলেছিল, কেউ যেন তার বড় ভাই আহমেদকে বকা না দেয়। আহমেদ যেমন দুষ্টু, তেমন মেধাবী। রাশা জানত না যে ওর ভাই আরেক বিছানায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। তাই সে তার ২৫ শেকেলের উত্তরাধিকারী করে গেছে ভাইকে। রাশা আর আহমেদের জন্ম এক বছরের ব্যবধানে। তাদের বড় হওয়ার কথা ছিল একসঙ্গে। হয়তো মায়ের মতো পিএইচডি করত। কিন্তু ওরা ভয়, ক্ষুধা আর আতঙ্কের জীবন একসঙ্গে কাটিয়ে মারা গেছে রাশা। পঙ্গু ভাই আহমেদ। গাজায় ইসরায়েলি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এই উপত্যকা বিশ্বের এককভাবে জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি আহমেদের মত অঙ্গচ্ছেদ হওয়া শিশুর স্থান হয়ে উঠেছে। বুধবার ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএর প্রধানের বরাতে মিডল ইস্ট মনিটর এবং আনাদোলু সংবাদ সংস্থা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ইউএনআরডব্লিউএর কমিশনার জেনারেল ফিলিপ লাজারিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় প্রায় ৪ হাজার অঙ্গচ্ছেদের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
লাজারিনি আরও বলেন, শিশুদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব শুধু শারীরিক আঘাত বা ক্ষুধায় সীমাবদ্ধ নয়; তাদের ক্ষত গভীর এবং অদৃশ্য। এর মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ, দুঃস্বপ্ন, আক্রমণাত্মক আচরণ এবং ভয়। অনেক শিশুকে ভিক্ষা, চুরি বা শিশুশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে, যা তাদের শৈশবকে কেড়ে নিচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, এই অবস্থা যত দীর্ঘ হবে, শিশুরা তাদের চলমান এবং গভীর ট্রমার ছায়ায় প্রজন্ম ধরে ভুগবে। তিনি অন্তত শিশুদের স্বার্থে হলেও গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের তদন্তকারীরা সম্প্রতি তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন যে, ইসরায়েল গাজায় জাতিগত হত্যা চালাচ্ছে। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ৬৫ হাজার ৪০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। গাজার কেন্দ্রে বাস্তুচ্যুতদের আশ্রয়স্থল একটি বাড়িতে ইসরাইলি বিমান হামলায় অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছে অঞ্চলটির সিভিল ডিফেন্স। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েল বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনি ভূখ-ে তাদের আক্রমণ জোরদার করেছে, যার ফলে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। গাজা উপত্যকা, ফিলিস্তিনি ভূখ- থেকে বার্তা সংস্থা এএফপি এ খবর জানিয়েছে। বেসরকারি সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, উত্তর আল-জাওয়াইদায় একটি বাড়িতে বিমান হামলায় ১১ জন নিহত ও আরো অনেকেই আহত বা নিখোঁজ হয়েছেন।
বাড়িটিতে বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। জরুরি সেবার কর্মকর্তারা জানান, নিহতদের মধ্যে কয়েকজন শিশু রয়েছে এবং তাদের লাশ নিকটবর্তী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। নাজিয়া আবু আমশা (একজন ফিলিস্তিনি, যার ভাগ্নে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করতে করতে নিহত হয়েছিল) বুধবার বলেন, আমরা ভিক্ষুক ও অসুস্থ হয়ে পড়েছি। আমরা আমাদের সন্তান, আমাদের ঘরবাড়ি ও আমাদের জায়গা হারিয়েছি। প্রায় দুই বছরে ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে অন্তত ৬৫ হাজার ৪১৯ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।
হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ তথ্যকে জাতিসংঘ নির্ভরযোগ্য বলে মনে করে। জাতিসংঘের এক তদন্তে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গাজায় গণহত্যা চালানোর অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা এ অপরাধে উসকানি দিয়েছেন। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লক্ষ্যবস্তুতে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের যুদ্ধবিমান গাজা উপত্যকায় ১৭০টি তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী লক্ষ্যবস্তুতে’ হামলা চালিয়েছে এবং এই অভিযান অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তিনটি ডিভিশনের সৈন্য গাজা সিটি ও এর উত্তরাঞ্চলে স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এ সময় তারা কয়েকজন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা এবং একটি অস্ত্র গুদাম ধ্বংসের দাবি করেছে। তবে এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ তারা হাজির করেনি। বিশ্বনেতাদের আহ্বান উপেক্ষা করে গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত রয়েছে।
তিনি আরও আশা প্রকাশ করেন, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে এই বিষয়ে কোনো ধরনের অগ্রগতির ঘোষণা আসবে। ট্রাম্পের পরিকল্পনার কয়েকটি মূল বিষয় হলো: গাজায় আটক সব জিম্মিকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া, গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা করা, গাজার প্রশাসনকে হামাসের প্রভাবমুক্ত করা এবং পর্যায়ক্রমে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার করা। স্থানীয়রা বলছেন,পানি নেই, খাবার নেই। আমাদের সন্তানরা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কেউ আমাদের নিয়ে চিন্তা করে না, না কোনো দেশ, না কোনো বিশ্বনেতা। এদিকে আরব ও মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে ট্রাম্প প্রশাসন গাজায় যুদ্ধবিরতির একটি পরিকল্পনা তুলে ধরেছে বলে জানিয়েছেন ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য-বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ। এতে বন্দিদের মুক্তি, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও গাজায় হামাসবিহীন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলার পাশাপাশি ধাপে ধাপে ইসরায়েলের সেনা প্রত্যাহারসহ মোট ২১টি প্রস্তাব রয়েছে। আরব নেতারা প্রস্তাবের বেশির ভাগ ধারা সমর্থন করলেও যোগ করেছেন কিছু শর্ত। এর মধ্যে আছে, পশ্চিম তীর দখল না করা, জেরুজালেমে বর্তমান অবস্থা বজায় রাখা, দ্রুত হামলা বন্ধ করা এবং গাজায় মানবিক সহায়তা বাড়ানোর মতো শর্ত।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন