ইসরায়েলি বাহিনীর বিমান হামলায় রক্তাক্ত হলো ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। শনিবার ভোরেই গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন ৫১ জন ফিলিস্তিনি। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ নিয়ে উপত্যকাটিতে ফিলিস্তিনি নিহতের সংখ্যা ছাড়াল সাড়ে ৬৫ হাজার। গাজায় অনাহারে শুক্রবার ১৭ বছর বয়সি এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে উপত্যকাটিতে অনাহারে ১৪৭ শিশুসহ মারা গেল ৪৪০ ফিলিস্তিনি।
তীব্র বোমা হামলার মধ্যেই গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া স্বজনদের উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। প্রাণ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন গাজায় আহতদের চিকিৎসা দিতে যাওয়া বিদেশি চিকিৎসকেরাও। ইসরায়েল উত্তর গাজার একমাত্র করিডোর বন্ধ রাখায় ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে সেখানে। এদিকে, শিগগিরই গাজায় যুদ্ধ বন্ধ ও জিম্মি মুক্তির চুক্তি হতে যাচ্ছে বলে আশা প্রকাশ করেছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বিমান হামলার মাত্রা বাড়িয়েছে দখলদার ইসরায়েল। গড়ে প্রতি ৮ থেকে ৯ মিনিট পর পর বিমান হামলা চালানো হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে গাজার বেসামরিকদের জন্য ভয়াবহ পরিণতির বিষয়ে শুক্রবার সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবিক বিষয়ক সমন্বয় অফিসের (ওসিএইচএ) উদ্ধৃতি দিয়ে সংস্থাটির মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক শুক্রবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় অভিযান জোরদার করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। ফলে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। গড়ে প্রতি ৮ থেকে ৯ মিনিট পর পর একটি করে বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের গতিবিধি নজরে রাখছেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, শুধু বৃহস্পতিবার উত্তর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে দক্ষিণে চলে গেছেন সাড়ে ১৬ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক। পথে ত্রাণকর্মীরা রয়েছেন, তবে তারা নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন বলেও জানান এই মুখপাত্র। ইসরায়েলের মুহুর্মুহু হামলা সত্ত্বেও লাখ লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিক পরিবার-পরিজন নিয়ে গাজা সিটিতে থেকে গেছে।
তাদের অনেকেরই সেই এলাকা ছেড়ে যাওয়ার মতো অর্থ বা সক্ষমতা নেই। এদের বেশির ভাগ মানুষই মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভর করেন, কারণ সেখানকার জরুরি পরিষেবাগুলো বন্ধ বা সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ডুজারিক জোর দিয়ে বলেন, গাজা উপত্যকা এবং এর বাইরে মানবিক কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে সহজ করার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ওসিএইচএ।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডাব্লিউএফপি) প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা কার্ল স্কাউ বলেছেন, গাজায় বর্তমানে যে পরিমাণ মানবিক সহায়তা প্রবাহিত হচ্ছে, তা ‘সমুদ্রে এক ফোঁটা জলের’ মতো এবং এর তুলনায় অনেক বেশি সহায়তা প্রয়োজন। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরের বাইরে আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্কাউ জানান, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৮০টি সহায়তা ট্রাক গাজায় প্রবেশ করছে। অথচ প্রয়োজন কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ ট্রাকÍ যা অবিশ্বাস্য। তিনি আরও বলেন, গাজার উত্তরাঞ্চলে পৌঁছানোও বর্তমানে সম্ভব হচ্ছে না, যেখানে ইসরায়েল গাজা সিটিতে তীব্র সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। অন্যদিকে, গাজা উপত্যকায় আইনশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ ভাঙন দেখা দিয়েছে, যার ফলে সবচেয়ে দুর্বল ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষরাও সাহায্য পাচ্ছে না।
স্কাউ জোর দিয়ে বলেন, ‘প্রচুর পরিমাণে মানবিক সহায়তা প্রয়োজন। এটি কেবল একটি জরুরি অবস্থা নয়Ñ এটি একটি মানবিক বিপর্যয়।’ এদিকে ফিলিস্তিনে চলমান আগ্রাসনের জন্য বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) গ্রেপ্তারি পরোয়ানার মধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে গাজার মানুষকে অনাহারে রাখছে। অথচ ইসরায়েল স্ব-ইচ্ছায় গাজায় খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে, ইসরায়েল গাজায় দুই মিলিয়ন টনেরও বেশি খাদ্য ও মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে। অর্থাৎ গাজার প্রতিটি পুরুষ, নারী ও শিশুর জন্য প্রায় এক টন সাহায্য। প্রতিদিন মাথাপিছু প্রায় তিন হাজার ক্যালোরি। এ কেমন অনাহারনীতি? যদি গাজার কোনো বাসিন্দার কাছে পর্যাপ্ত খাবার না পৌঁছায়, তবে তার কারণ হলো হামাস সে খাবার চুরি করছে। হামাস চুরি করছে, মজুত করছে এবং তাদের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অত্যধিক দামে তা বিক্রি করছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তির জন্য তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে নিবিড় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। শুক্রবার (২৬ সেপ্টেম্বর) নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে ট্রাম্প বলেন, এই সপ্তাহে একাধিক মুসলিম দেশের নেতা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধের অবসানের পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছেন, একটি সফল চুক্তিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি হামাস যোদ্ধারা এ আলোচনার ব্যাপারে অবগত রয়েছে। ট্রাম্প লিখেছেন, গত চার দিন ধরে নিবিড় আলোচনা চলছে। একটি সফল চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য যত দিন প্রয়োজন তত দিন তা চলবে।
এই অঞ্চলের সব দেশই এতে জড়িত। মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ বলেন, ট্রাম্প ওই নেতাদের কাছে ২১ দফা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনা পেশ করেছেন। ট্রাম্প যুদ্ধের দ্রুত অবসানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তবে আট মাস পার হলেও কোনো সমাধান মেলেনি। তার মেয়াদ শুরু হয়েছিল ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে দুই মাসব্যাপী যুদ্ধবিরতি দিয়ে, যা শেষ হয় গত ১৮ মার্চ ইসরায়েলি হামলায় ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের পর গাজা ও ফিলিস্তিনে যুদ্ধবিরতি এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে তারা একটি সমঝোতায় পৌঁছেছেন।