শনিবার দুপুরের ঘটনা। শোরবাসি পরিবারের সদস্যরা ধ্বংসস্তূপে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। হঠাৎ একটি বিস্ফোরণের শব্দে বাইরে আসেন তারা। তখন দেখতে পান, তাদের ছয় বছর বয়সি যমজ শিশু ইয়াহিয়া ও নাবিলা মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয়রা জানান, শিশুরা খেলার সময় একটি গোলাকার বস্তু খুঁজে পায়, যা দেখতে খেলনার মতো ছিল। স্পর্শ করতেই এটি বিস্ফোরিত হয়। আহত শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে, তবে তাদের আগের মতো সুস্থ জীবনে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। গাজার ফিলিস্তিনিদের জন্য এখন এক নতুন আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে ইসরায়েলি বাহিনীর ফেলা অবিস্ফোরিত বোমা। গত ১০ অক্টোবর কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির পর অনেকেই নিজ নিজ এলাকায়, বাড়িতে ফিরছেন। সেখানে অবশ্য কোনো স্থাপনা অবশিষ্ট নেই। তাই বাধ্য হয়েই খোলা আকাশের নিচে তাঁবু গেড়ে থাকতে হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। তবে সেখানেও বিপত্তি। কারণ, আবাসিক এলাকার বেশির ভাগ অংশেই ইসরায়েলে ফেলা বোমা ও অন্যান্য বিস্ফোরক অবিস্ফোরিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার খবরে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হওয়া গাজার খান ইউনিসে নিজের বাড়িতে ফিরে এসে এক ফিলিস্তিনি একটি বিস্ফোরকবোঝাই অবিস্ফোরিত কিন্তু বিধ্বস্ত সাঁজোয়া যান দেখতে পান। ধ্বংসস্তূপে আশ্রয়হীন ওই ব্যক্তি বাধ্য হয়ে সেই সাঁজোয়া যানটির ওপরই পরিবার নিয়ে তাঁবু ফেলেছেন। যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজার দক্ষিণের এই শহরে ফিরতে শুরু করেছে বাস্তুচ্যুত বহু পরিবার। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ইতিমধ্যে দক্ষিণের ত্রাণশিবিরগুলো থেকে ৪ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ উত্তরাঞ্চলের ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকায় ফিরে গেছেন। ফিরে এসে অনেকে দেখছেন, বসতবাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কোথাও মাটির নিচে লুকানো বিস্ফোরক, কোথাও পড়ে আছে দাহ্য কোনো অস্ত্র-বোমা। খান ইউনিসের বাসিন্দা আয়মান কাদুরা জানান, নিজের বাড়ির ধ্বংসাবশেষের ভেতর তিনি খুঁজে পান একটি দূরনিয়ন্ত্রিত সাঁজোয়া বিস্ফোরক রোবট, যা ইসরায়েলি সেনারা গাজাজুড়ে ব্যবহার করেছিল পুরো ভবন উড়িয়ে দিতে। কাদুরা বলেন, তার প্রতিবেশীর বাড়িতেও এমন আরেকটি যন্ত্র ছিল। দুটি বাড়ির মাঝখানে এফ-১৬ বিমানের ক্ষেপণাস্ত্রে তিন মিটার গভীর গর্ত তৈরি হয়েছে। তিনি আশঙ্কা করছেন, যদি এসব অবিস্ফোরিত যন্ত্র সক্রিয় হয়, পুরো এলাকা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তিনি নিয়মিত যন্ত্রগুলো বালি দিয়ে ঢেকে রাখেন।
জাতিসংঘের স্যাটেলাইট বিশ্লেষণ কেন্দ্র ইউনোস্যাট জানিয়েছে, শুধু খান ইউনিস গভর্নরেটেই ৪২ হাজারের বেশি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে শহর এলাকায় অন্তত ১৯ হাজার ভবন ধ্বংস বা আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত। পুরো গাজা উপত্যকায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির সংখ্যা ২ লাখ ২৭ হাজার ছাড়িয়েছে। জাতিসংঘের মাইন অ্যাকশন সার্ভিস জানিয়েছে, গাজাজুড়ে অবিস্ফোরিত অস্ত্রেও ঝুঁকি ‘অবিশ্বাস্যভাবে বেশি’। সংস্থাটি এখন পর্যন্ত অন্তত ৫৬০টি বিস্ফোরক বস্তু শনাক্ত করেছে, তবে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত এসব অবিস্ফোরিত অস্ত্রের কারণে ৩২৮ জন নিহত বা আহত হয়েছেন।
গাজায় শীত আসার আগেই মানবিক বিপর্যয় আরও ঘনিয়ে আসছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে, ইসরায়েলের বাধার কারণে আশ্রয় ও ত্রাণসামগ্রী এখন জর্ডান ও মিসরের গুদামে আটকে আছে, যা গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। শনিবার (২৫ অক্টোবর) এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানায়, শীত ঘনিয়ে আসায় গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষদের আশ্রয় ও উষ্ণতার তীব্র প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কিন্তু শরণার্থীদের জন্য পাঠানো সামগ্রী জর্ডান ও মিসরের ইউএনআরডব্লিউএ গুদামে আটকে আছে, ইসরায়েল প্রবেশে বাধা দিচ্ছে’। বিবৃতিতে ইউএনআরডব্লিউএ দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানায়।
এর আগে বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম ‘কান’ এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজায় ইউএনআরডব্লিউএর কার্যক্রম পুনরায় চালুর অনুমতি দিতে চায় না।
দখলকৃত পশ্চিম তীরে অব্যাহত রয়েছে ধরপাকড় অভিযান। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি তৃতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করলেও ইসরায়েলি আগ্রাসন থামেনি এক মুহূর্তের জন্যও। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানায়, গতকাল শনিবার রাতে গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত শরণার্থীশিবিরে ড্রোন হামলা চালিয়ে এক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত চারজন। স্থানীয় আল-আওয়াদা হাসপাতাল এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, তাদের ওই হামলার লক্ষ্য ছিল ইসলামিক জিহাদ আন্দোলনের এক সদস্যকে হত্যা করা। এদিকে, গাজার ধ্বংসস্তূপে ফিরে আসা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের জীবন আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। শনিবার গাজা শহরের একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ধসে ৯ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রোববার (২৬ অক্টোবর) সকাল থেকেই গাজার পূর্বাঞ্চলজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এতে ধারণা করা হচ্ছে, ইসরায়েলি বাহিনী আবারও ভারী বিস্ফোরক অস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে। বিশেষ করে পূর্ব দেইর আল-বালাহ ও আল-জুয়াইদা এলাকায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে। এতে করে ইসরায়েলি সেনাদের ঘোষিত প্রত্যাহার সীমারেখার বাইরেও গোলাবারুদ ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজার সব টানেল ধ্বংসের নির্দেশ দিয়েছেন দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে গাজার ‘ইয়েলো লাইন’-এর ইসরায়েলি অংশে সব সুড়ঙ্গ ধ্বংস করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুড়ঙ্গ ধ্বংস করাই এখন সেনাবাহিনীর প্রধান মিশন। তার দাবি, গাজায় হামাসের ৬০ শতাংশ সুড়ঙ্গ এখনো অক্ষত রয়েছে। তিনি আরও বলেন যে ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরিচালক এডুয়ার্ড বেগবেডার বলেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি শিশুদের বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা এবং মর্যাদার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। বিশ্ব এই যুদ্ধবিরতির যুযোগ ব্যর্থ হতে দিতে পারে না। রোববার (২৬ অক্টোবর) লাইভ প্রতিবেদনে আলজাজিরা জানিয়েছে, বিবৃতিতে বেগবেডার বলেছেন, ‘গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে।’
হামাসকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাদের তিনি ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছেন। বলেছেন, এর মধ্যে দুজন মার্কিনসহ নিহত সব জিম্মির মৃতদেহ এ সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। শনিবার তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে খুব শক্তিশালী শান্তি টিকিয়ে রাখার বিষয়টি এই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন জিও নিউজ।
ইসরায়েলি বন্দিদের মরদেহ উদ্ধারে সহায়তা করতে মিসরীয় ভারী যানবাহনের একটি বহর গাজা উপত্যকায় ঢুকেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা সংঘাতের মধ্যে এটিকে গাজার ভেতরে প্রথম বড় ধরনের বিদেশি উদ্ধার মিশন হিসেবে দেখা হচ্ছে। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য টাইমস অব ইসরায়েলের বরাতে আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় মিসরীয় উদ্ধারকারী দলকে প্রবেশের অনুমোদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মিসরীয় দলটি গাজায় ঢোকার আগে রাফাহ সীমান্তে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর তল্লাশির মধ্য দিয়ে যায়। রোববার (২৬ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে আল-সাররাজ বলেন, ‘গাজা নগরীর পুনর্গঠন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ চালিয়ে যেতে অন্তত ২৫০টি ভারী যানবাহন এবং প্রায় ১,০০০ টন সিমেন্ট প্রয়োজন।
গাজা উপত্যকার মধ্যাঞ্চলের দেইর আল-বালাহে ইসরায়েলি এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের নিক্ষিপ্ত একটি অবিস্ফোরিত বোমার পাশে ফিলিস্তিনিরা দাঁড়িয়ে আছে।
গাজা উপত্যকার মিশর সীমান্তের কাছে রাফায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর ফেলা একটি অবিস্ফোরিত বোমার দিকে তাকিয়ে আছেন ফিলিস্তিনিরা।

