ঢাকা সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

১৭ মাসে শেয়ারবাজারে একটি কোম্পানিও আসেনি

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ০৩:২০ এএম

গত বছরের ৭ মার্চ টেকনো ড্রাগস নামে একটি কোম্পানিকে আইপিওর মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপর গত ১৭ মাসে একটি কোম্পানিও প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে অনুমতি পায়নি। অথচ চলতি বছরের মে মাসে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি কয়েকটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন। সেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে (এমএনসি) থাকা সরকারি শেয়ার অফলোড, দেশীয় বড় বড় কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করা এবং বড় বড় কোম্পানি যাতে ব্যাংকঋণ নেওয়ার বদলে পুঁজিবাজারে বন্ড বা শেয়ার ছেড়ে পুঁজি সংগ্রহে আগ্রহী হয়, সে লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। তবে এসব নির্দেশনার পরও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি ১৮টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানকে (এসওই) বাজারে নিয়ে আসার ব্যাপারে সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৭ মার্চ টেকনো ড্রাগস কোম্পানিকে প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছিল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এরপর গত ১৭ মাসে একটি কোম্পানিও আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে অনুমতি পায়নি। গত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএসইসির দায়িত্ব নেন খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর পুঁজিবাজার সংস্কারের কথা বলে আগের প্রায় এক ডজন কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করা হয়। এসব আইপিও আবেদন বাতিল করায় নতুন কোনো আইপিও জমাও দেয়নি মার্চেন্ট ব্যাংকাররা। এতে আইপিও পাইপলাইন শূন্য হয়ে যাওয়ায় নতুন কোনো কোম্পানিকে মূলধন উত্তোলনের অনুমোদনও দিতে পারেনি সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন। সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘ সময় ধরে এ ধরনের অচলাবস্থা নজিরবিহীন বলে উল্লেখ করেন।

জানা যায়, ২০০৭ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২৬টি কোম্পানি আইপিওর মাধ্যমে মূলধন উত্তোলন করে। গত আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিগত ১৪ মাসের বেশি সময়ে নতুন কোনো কোম্পানির আইপিওর মাধ্যমে মূলধন উত্তোলনের অনুমোদন দিতে পারেনি নতুন কমিশন। ফলে দেড় বছর ধরে আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলন একদম বন্ধ, যার কারণে নতুন শেয়ারের জোগান শূন্য। আইপিওর ইস্যু ম্যানেজার হিসেবে কাজ করা মার্চেন্ট ব্যাংকাররা বিএসইসির স্থগিত সংস্কার এজেন্ডা, বিশেষ করে পাবলিক ইস্যু রুলসের সংশোধনে দীর্ঘ বিলম্বকে এই অচলাবস্থার জন্য দায়ী করেন।

জানা যায়, আগস্ট মাসে সরকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে একটি যৌথ বৈঠক করে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব ওবায়দুর রহমানের সভাপতিত্বে এ বৈঠকে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে জানানো হয় যে দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগগুলোতে সরকার তার নিজস্ব শেয়ারের ৫ শতাংশ এবং বিদেশি অংশীদারদের শেয়ারের ৫ শতাংশ অফলোডের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১৬ অক্টোবর টেক্সটাইল খাতের কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্ত করতে দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইর সঙ্গে বৈঠক করে ডিএসই। এর আগেও এটি ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) ও বাংলাদেশ সিরামিক ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমইএ) সঙ্গেও বৈঠক করেছে। ওষুধশিল্প খাতের কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে আনতে বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও বৈঠক করবে ডিএসই। তবে এখন পর্যন্ত এসব বিষয়ে কোনো ফলাফল চোখে পড়েনি।

মার্চেন্ট ব্যাংকের তথ্যমতে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পরই পুঁজিবাজার সংস্কারের কথা বলে আগের প্রায় এক ডজন কোম্পানির আইপিও আবেদন বাতিল করে। কমিশন কাউকে কাউকে আবেদন প্রত্যাহার করার নির্দেশনা দেয়, আবার কাউকে পাবলিক ইস্যু রুলস সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত নতুন আইপিও জমা না দেওয়ার পরামর্শও দেয়। এ কারণে কেউই নতুন আবেদন জমা দেয়নি। আইপিও অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে বিএসইসির মুখপাত্র আবুল কালাম বলেন, আইপিওর মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে মূলধন উত্তোলনে পাবলিক ইস্যু রুলসে সংশোধন আনা হচ্ছে। বিদ্যমান পাবলিক ইস্যু রুলস অনুযায়ী, উদ্যোক্তারা মূলধন উত্তোলনে আবেদন জানাতে পারত। কিন্তু কমিশনের হাতে কোনো আইপিও আবেদন না থাকায় অনুমোদন দিতে পারেনি। রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বাধীন কমিশন বিগত ১৫ বছরের অনিয়ম খুঁজে বের করতে অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি এবং বাজার সংস্কারে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্সের সুপারিশের ভিত্তিতে আইপিওর মাধ্যমে মূলধন উত্তোলনে পাবলিক ইস্যু রুলস সংশোধনের উদ্যোগ নেয় কমিশন। টাস্কফোর্স পাবলিক ইস্যু রুলসের খসড়া বিধিবিধান কমিশনে জমা দিলেও আইনটি চূড়ান্তে স্টেকহোল্ডারদের মতামত সংগ্রহের জন্য প্রকাশ করেনি।

বিএসইসি সূত্রে জানা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সরকারি মালিকানাধীন যমুনা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ও তিতাস গ্যাস কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছেÑ ব্র্যাক বাংক, শাহজালাল ইসলামী, প্রিমিয়ার, ট্রাস্ট বাংক ও এসিআই ফর্মুলেশন। ওই সময়েই সাতটি বিমা কোম্পানি ও ছয়টি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত হয়। এসিআই ফর্মুলেশনসহ ম্যানুফাকচারিং খাতের চারটি কোম্পানি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তালিকাভুক্ত হয়। ২০০৯ সালে তালিকাভুক্ত হয় বহুজাতিক কোম্পানি গ্রামীণফোন, যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কালেই তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়। গ্রামীণফোন বর্তমানে দেশের পুঁজিবাজারের সবচেয়ে বড় মূলধনী কোম্পানি।

বর্তমানে পুঁজিবাজারে মোট ১৯টি সরকারি কোম্পানি তালিকাভুক্ত রয়েছে। সর্বশেষ ২০১২ সালে বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়। এরপর আর কোনো সরকারি কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসেনি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধমে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। পাঁচ বছর মেয়াদে তিন দফায় পূর্ণ মেয়াদ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধমে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করলেও ওই বছরের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের বেশি সময় মেয়াদে প্রায় ২০০ কোম্পানির মূলধন উত্তোলন করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। এসব মূলধন উত্তোলনে আইন ভেঙে আইপিও, বিশেষ বিশেষ গ্রুপকে সুবিধা দেওয়া এবং কারসাজি হলেও ব্যবস্থা না নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।