ঢাকা মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

বৈঠকে অচলাবস্থা

ফের উত্তপ্ত আফগান-পাক সীমান্ত

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২৫, ০২:৫৮ এএম

দুই প্রতিবেশী দেশ। যা ছিল একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র। এখন পরিণত হয়েছে পরস্পরের শত্রুতে। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে টানা সংঘর্ষে প্রতিদিন ঝরছে রক্ত। কিন্তু এই বৈরিতা হঠাৎ তৈরি হয়নি। এর শিকড় লুকিয়ে আছে প্রায় ১৩০ বছর আগের একটি চুক্তিতে। চুক্তিটির নাম ডুরান্ড চুক্তি। ১৮৯৩ সালে আফগান আমির আবদুর রহমান খান ও ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্রসচিব স্যার মর্টিমার ডুরান্ডের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয় একটি সীমান্ত চুক্তি। যা ‘ডুরান্ড চুক্তি’ নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে আফগানিস্তানের ভেতরকার পশতু অধ্যুষিত অঞ্চল বিভক্ত হয়ে পড়ে ব্রিটিশ ভারতের অধীনে। এই বিভাজনরেখাই পরে পরিচিত হয় ‘ডুরান্ড লাইন’ নামে। আফগানদের চোখে এটি ছিল অন্যায্য ঔপনিবেশিক চুক্তি। যা তাদের জাতিগত ও ভূখ-গত ঐক্য ভেঙে দেয়। কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে এটি ছিল দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের নিরাপত্তা বলয়। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলে, নতুন রাষ্ট্রটি ডুরান্ড লাইনকে তার বৈধ সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু আফগানিস্তান তা প্রত্যাখ্যান করে।

এমনকি পাকিস্তানের জাতিসংঘ সদস্যপদেও আফগানিস্তানই ছিল একমাত্র দেশ, যে না ভোট দিয়েছিল। এভাবেই শুরু হয় দুই প্রতিবেশীর অবিশ্বাসের ইতিহাস। শুরু হয় পাকিস্তান-আফগান সীমান্ত সংকট। ১৩০ বছরের পুরোনো সীমান্তচুক্তি আজও রক্তে লেখা হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও পাক-আফগান সীমান্তে সংঘর্ষ বেধেছিল দুই দেশের। তারপর যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে সই করে দুই পক্ষ। উত্তেজনা প্রশমনে উভয় দেশের প্রতিনিধিদল ইস্তাম্বুলে মিলিত হয়েছে সম্প্রতি। দোহায় স্বাক্ষরিত চুক্তি মেনে চলার বিষয়ে আলোচনা করতেই এই বৈঠক। তারপরে এই সহিংসতার ঘটনা ঘটল সীমান্ত এলাকায়। আফগানিস্তান সীমান্তের কাছে সংঘর্ষে পাঁচ পাকিস্তানি সেনা এবং ২৫ জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাবি, গত ২৫ এবং ২৬ অক্টোবর আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানের কুররাম ও উত্তর ওয়াজিরিস্তান জেলায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে জঙ্গিরা। সেই সময়ই সংঘর্ষ বেধে যায়। পাকিস্তানের সামরিক মিডিয়া উইং বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলে, এই নতুন অনুপ্রবেশের চেষ্টার পর সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় আফগান সরকারের তৎপরতা নিয়ে সন্দিহান পাকিস্তান। এদিকে অনুপ্রবেশকারীদের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও সন্দেহ তৈরি হয়েছে। আফগানিস্তানের তালিবান সরকার এখনো ইসলামাবাদের সর্বশেষ অভিযোগের জবাব দেয়নি। তবে জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করে আফগান সরকার বলেছে, পাকিস্তানের সামরিক অভিযান আফগান সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে। উল্লেখ্য, কয়েক দিন আগে ডুরান্ড লাইন বরাবর পাকিস্তানি ও আফগান সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বেধেছিল, তার কেন্দ্রে ছিল এই ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ (টিটিপি)।

এদিকে তালিবানের অভিযোগ, পাকিস্তান সরকার এবং সেনা ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি সংগঠনকে সাহায্য করছে। এদিকে পাকিস্তানের অভিযোগ, আফগানের তালিবান সরকার টিটিপি সদস্যদের আশ্রয় দিচ্ছে, যারা পাকিস্তানে হামলা করছে। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বাইতুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ফেডারেল শাসিত উপজাতি এলাকার বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীকে একত্র করে টিটিপি গঠিত হয়। এই গোষ্ঠীকে আন্তর্জাতিকভাবে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। আল-কায়েদা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়া হিসেবে এর জন্ম। বর্তমানে টিটিপির মূল লক্ষ্য হলো পাকিস্তান সরকারকে সরিয়ে তাদের নিজস্ব মতাদর্শে একটি ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

এই আবহে গত ৯ অক্টোবর মধ্যরাতের দিকে কাবুলের পূর্বাঞ্চলে শক্তিশালী বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর পাক সীমান্তে সেনা আউটপোস্টে পাল্টা হামলা চালায় আফগনরা। সেই হামলায় পাকিস্তানের ৫৮ সেনা জওয়ান নিহত হয় বলে দাবি করে তালিবান। এদিকে পাক সেনা দাবি করে, তাদের ২৩ জন জওয়ানের মৃত্যু হয়েছে। তারপর গত ১৪ অক্টোবর রাতে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। তাতে কমপক্ষে ১৫ আফগান নাগরিক এবং পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনীর ৬ জন নিহত হয়েছিল। তুরস্কে চলমান বৈঠকে আফগানিস্তানের তালেবান সরকার ও পাকিস্তানের প্রতিনিধিদল মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতিতে চূড়ান্ত সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, টানা ১৫ ঘণ্টা আলোচনার পর গত রবিবার আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাতের প্রতিনিধিদল পাকিস্তানি প্রতিনিধিদের কাছে একটি খসড়া প্রস্তাব পেশ করেছে।

প্রস্তাবে আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে তিনটি প্রধান দাবি তুলে ধরা হয়েছেÑ১. পাকিস্তান যেন আফগানিস্তানের আকাশসীমা ও স্থলসীমা লঙ্ঘন না করে। ২. পাকিস্তান যেন আফগানবিরোধী কোনো গোষ্ঠীকে নিজেদের ভূখ- ব্যবহার করতে না দেয়। ৩. সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমনে উভয় পক্ষের পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, তিনি চাইলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চলমান সংঘাত খুব দ্রুত ‘সমাধান’ করতে পারবেন। রোববার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত আসিয়ান সম্মেলনের ফাঁকে আয়োজিত থাইল্যান্ড-কাম্বোডিয়া শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন। ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ও দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে ‘অসাধারণ মানুষ’ বলে প্রশংসা করেন। এক প্রতিবেদনে এ খবর দিয়েছে জিও নিউজ। ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা এখন প্রতি মাসে একটি করে যুদ্ধের অবসান ঘটাচ্ছি। এখন শুধু একটি বাকি আছেÑ শুনেছি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়েছে। কিন্তু আমি সেটাও খুব দ্রুত মিটিয়ে ফেলব। আমি দুজনকেই চিনিÑ ফিল্ড মার্শাল ও প্রধানমন্ত্রী দুজনেই দুর্দান্ত মানুষ। আমি নিশ্চিত, খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টা সমাধান হবে।’

তিনি আরও বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠা তার সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। ‘যদি আমি সময় নিয়ে লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে পারি, সেটিই সবচেয়ে বড় অর্জন’, ট্রাম্প বলেন। ‘অন্য অনেক প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ শুরু করেন, আমি তার উল্টোটা করেছিÑ যুদ্ধের ইতি টেনেছি।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদ ফাকিরি বলেন, ‘যদি তুরস্কে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনায় একটি সামগ্রিক চুক্তি হয় এবং দুই দেশ ডুরান্ডরেখা বরাবর উত্তেজনা প্রশমনে ও পারস্পরিক সহযোগিতায় সম্মত হয়, তাহলে এই চুক্তি অন্তত কয়েক মাস টিকে থাকতে পারে।’ সূত্র আরও জানায়, ইসলামি আমিরাতের খসড়া প্রস্তাবটি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে পাকিস্তানকে হস্তান্তর করা হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তানও তাদের পক্ষ থেকে একটি খসড়া প্রস্তাব জমা দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রস্তাব মূলত আফগান ভূখ- থেকে সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশ ও পরিকল্পিত হামলা মোকাবিলা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে তৈরি।

আফগানিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক আসাদ আতাল মন্তব্য করেন, ‘পাকিস্তানের অভিযোগ ও দাবি ভিত্তিহীন। আফগানিস্তান কারো জন্য হুমকি নয় এবং কোনো দেশের প্রতি তাদের শত্রুতামূলক মনোভাবও নেই।’ সূত্র জানায়, সংঘর্ষবিরতি বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণের জন্য চারপক্ষীয় একটি চ্যানেল গঠন করা হচ্ছে। এই চ্যানেল উভয় পক্ষের অভিযোগ মূল্যায়ন করবে এবং তথ্য বিনিময়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে।