শীত আসছে। মানুষ এখনো ক্ষুধার্ত, চাহিদা বিপুলÑ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) মুখপাত্র আবির এতেফা এ কথা বলেন। যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে ইসরায়েলি সেনারা কিছুটা পিছু হটায় অনেকে উত্তর গাজায় ফিরে যাচ্ছেন। কিন্তু ফিরে গিয়ে তারা দেখতে পাচ্ছেন বাড়িঘর, পাড়া-মহল্লা সব ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। অনেক পরিবার এখনো তাঁবু বা কাঁচা ঘরে আশ্রয় নিচ্ছে। গাজা সিটির বাসিন্দা খালেদ আল-দাহদুহ জানান, তার বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। শীতের প্রস্তুতি হিসেবে ইট-কাদামাটি দিয়ে নিজেই ছোট্ট আশ্রয় বানিয়েছেন। ‘আমাদের কাছে তাঁবু নেই, তাই কাদা দিয়ে একটা ছোট্ট ঘর তুলেছি। এটা ঠান্ডা, পোকামাকড় আর বৃষ্টি থেকে অন্তত কিছুটা রক্ষা দেয়।’ বলেন তিনি।
যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ত্রাণ সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে, তবে এখনো মাত্র দুটি প্রবেশপথ খোলা থাকায় তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ‘আমাদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার প্রয়োজন। দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সবকিছু প্রয়োজন। আমরা সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় আছি। ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞার কারণে গাজা উপত্যকায় খাদ্য ও অন্যান্য মানবিক সরবরাহ পৌঁছানো ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, সাহায্য সংস্থাগুলো ‘সময়ের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায়’ লিপ্ত। কারণ বোমাবিধ্বস্ত ছিটমহলজুড়ে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। ডব্লিউএফপি বর্তমানে গাজায় ৪৪টি খাদ্য বিতরণকেন্দ্র পরিচালনা করছে। অক্টোবরের ১০ তারিখ থেকে শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতির পর থেকে এক মিলিয়নের বেশি ফিলিস্তিনিকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি জানায়। তবে গাজার উত্তরাঞ্চলে পৌঁছানো এখনো কঠিন। আগস্টে সেখানে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার পরও উত্তরাঞ্চলের প্রবেশপথ বন্ধ থাকায় ত্রাণ কাফেলাগুলোকে দক্ষিণ দিক দিয়ে ধীর ও জটিল পথে যেতে হচ্ছে।
‘ব্যাপক পরিমাণে সরবরাহের জন্য ডব্লিউএফপির সমস্ত ক্রসিং খোলা থাকা প্রয়োজন, বিশেষ করে উত্তরে। খাদ্য দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে যেখানে প্রয়োজন সেখানে পরিবহনের অনুমতি দেওয়ার জন্য গাজাজুড়ে গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে সম্পূর্ণ প্রবেশাধিকারও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ বলেন আবির এতেফা।
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, ১০ থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে মোট ৩ হাজার ২০৩টি বাণিজ্যিক ও ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছেÑ গড়ে প্রতিদিন ১৪৫টি, যা যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সংখ্যার মাত্র ২৪ শতাংশ। এদিকে, যুদ্ধবিরতি চললেও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা অব্যাহত রয়েছে। মঙ্গলবার গাজা সিটির তুফাহ এলাকায় ইসরায়েলি কোয়াডকপ্টারের গুলিতে একজন নিহত ও একজন আহত হন। একই দিনে জাবালিয়া এলাকায় ইসরায়েলি সেনার গুলিতে আরও একজনের মৃত্যু হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২৪০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬০৭ জন আহত হয়েছেন। ইসরায়েল এসব সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, হামাস এখনো নিহত ইসরায়েলি বন্দিদের দেহাবশেষ ফেরত দেয়নি, যা যুদ্ধবিরতির শর্ত ভঙ্গের শামিল। মঙ্গলবার হামাস আন্তর্জাতিক রেডক্রসের মাধ্যমে এক ইসরায়েলি বন্দির মরদেহ হস্তান্তর করেছে বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
ফিলিস্তিনের গাজায় যুদ্ধবিরতি চলমান থাকলেও ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। এর ফলে গাজায় তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে এবং ক্ষুধা ও দুর্ভোগে কাতর হচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। মূলত সীমিত সীমান্ত খোলা থাকায় ত্রাণ সরবরাহে বড় বাধা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। বৈশ্বিক এই সংস্থা এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। বুধবার (৫ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থাগুলো। তবে ইসরায়েলের অব্যাহত বিধিনিষেধের ফলে সহায়তা সরবরাহে বড় বাধা তৈরি হয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। মঙ্গলবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মুখপাত্র আবির ইতেফা বলেন, ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গত মাসে যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সীমিতভাবে সীমান্ত খোলা থাকার কারণে ত্রাণের পরিমাণ এখনো অত্যন্ত কম। তিনি বলেন, ‘আমাদের পূর্ণ প্রবেশাধিকার দরকার। দ্রুতগতিতে ত্রাণ সরানো জরুরি। আমরা সময়ের সঙ্গে দৌড়াচ্ছি। শীত চলে আসছে, অথচ মানুষ এখনো ক্ষুধায় ভুগছে।’ ডব্লিউএফপি জানায়, তারা গাজাজুড়ে ৪৪টি স্থানে খাদ্য বিতরণ কার্যক্রম চালাচ্ছে এবং ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে ১০ লাখেরও বেশি মানুষকে খাদ্যসহায়তা দিয়েছে। তবে সংস্থাটি জানায়, যে পরিমাণ খাদ্য গাজায় প্রবেশ করছে, তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে উত্তর গাজায় পৌঁছানো এখনো কঠিন। গত আগস্টেই বৈশ্বিক পর্যবেক্ষক সংস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি শনাক্ত করেছিল। ইতেফা বলেন, উত্তর গাজার প্রবেশপথ এখনো বন্ধ। ফলে আমাদের ত্রাণ কাফেলাগুলোকে দক্ষিণ দিকের দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় ঘুরে যেতে হচ্ছে। কার্যকর ত্রাণ বিতরণের জন্য সীমান্ত পারাপারের সব পয়েন্ট খোলা দরকার, বিশেষ করে উত্তর দিকেরগুলো। এদিকে যুদ্ধবিরতির পর ইসরায়েলি সেনারা ‘ইয়েলো লাইন’-এ পিছু হটার পর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি উত্তর গাজার বাড়িতে ফিরে গেছে। কিন্তু অধিকাংশই ফিরে দেখেছে, তাদের ঘরবাড়ি ও আশপাশের এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। অনেকে এখনো তাঁবু ও অস্থায়ী আশ্রয়ে বসবাস করছে। এ ছাড়া যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী আরও ত্রাণ গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
শীতের কঠিন সময় ঘনিয়ে আসায় তাদের উদ্বেগও বেড়েছে অনেকটা। গাজার সরকারি তথ্য অফিস জানিয়েছে, ১০ থেকে ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ৩ হাজার ২০৩টি বাণিজ্যিক ও ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ, গড়ে দিনে ১৪৫টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। যদিও যুদ্ধবিরতির চুক্তি অনুযায়ী দৈনিক ৬০০টি ট্রাক গাজায় প্রবেশ করার কথা। এরই মধ্যে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার গাজা সিটির তুফাহ এলাকায় ইসরায়েলি কোয়াডকপ্টার হামলায় একজন নিহত ও একজন আহত হন। উত্তর গাজার জাবালিয়ায়ও সেনাদের গুলিতে একজন নিহত হওয়ার খবর দিয়েছে স্থানীয় হাসপাতাল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৪০ জন নিহত ও ৬০৭ জন আহত হয়েছে।
দখলকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামে ইসরায়েলি সেনা ও অবৈধ সেটেলারদের হামলা বেড়েছে। ফিলিস্তিনি বার্তা সংস্থা ওয়াফার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্প্রতি এসব এলাকায় ব্যাপক হামলা, ভূমি দখল, অগ্নিসংযোগ ও ফসল লুটের ঘটনা ঘটছে। মঙ্গলবার গভীর রাতে নাবলুসের দক্ষিণে ওয়াদি ইয়াসুফ এলাকায় ইসরায়েলি সেটেলারদের বড় একটি দল সেনাবাহিনীর সহায়তায় ফিলিস্তিনিদের কৃষিজমিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
গত দুই বছর ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন চালিয়ে ৬৯ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে দখলদার ইসরায়েল। দেশটির সরকারি তথ্য বলছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে গত দুই বছরে ইসরায়েলের সামরিক ব্যয় বেড়ে ৭৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলু। মঙ্গলবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য উদ্ধৃতি করে ইসরায়েলের সরকারি গণমাধ্যম কে এ এন জানিয়েছে, দুই বছরের যুদ্ধে এখন পর্যন্ত মোট ২৫০ বিলিয়ন শেকেল বা ৭৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। ইসরায়েলের উগ্র-ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আগামীতে ইসরায়েলের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন ছিল।’
গাজায় বারবার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। মঙ্গলবার কাতারের দোহায় দ্বিতীয় বিশ্ব সামাজিক উন্নয়ন শীর্ষ সম্মেলনের এক ফাঁকে সাংবাদিকদের উদ্দেশে এ কথা বলেন তিনি। গুতেরেস বলেন, ‘গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা নিয়ে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই সহিংসতা বন্ধ করতে হবে এবং সব পক্ষকে শান্তিচুক্তির প্রথম পর্যায়ের সিদ্ধান্ত মেনে চলতে হবে।’ হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলেও ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিনই তা লঙ্ঘন করেই চলেছে। গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল ১২৫ বারের বেশি লঙ্ঘন করেছে। সেই সঙ্গে শতাধিক বেসামরিক মানুষকে হত্যা করেছে। গাজা অঞ্চলজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের মোট সংখ্যা ৬৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। একই সময়ে ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে।

