ঢাকা শুক্রবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫

ন্যাটো-রাশিয়া যুদ্ধ অনিবার্য

ভিনদেশ ডেস্ক
প্রকাশিত: নভেম্বর ১৪, ২০২৫, ০১:৪৫ এএম

ঘন কুয়াশা। যে রাস্তাটি চলে গেছে, তাতে ধ্বংসাবশেষের ছড়াছড়ি। এর মধ্য দিয়েই মোটরসাইকেলে করে এগিয়ে চলেছেন রাশিয়ার সেনারা। মোটরসাইকেলগুলোর সঙ্গে রয়েছে ভাঙাচোরা গাড়ি। কোনোটির দরজা নেই, কোনোটির জানালা। সেগুলোতেও বসে আছেন সেনারা। কারো জায়গা হয়েছে আবার গাড়ির ছাদে। পাশেই রাখা একটি ড্রোন। রাশিয়ার ওই সেনারা এগিয়ে যাচ্ছিলেন ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে পোকরোভস্ক ও কুপিয়ানস্ক শহরের গভীরের দিকে। ইউক্রেনের পোকরোভস্ক শহরকে রাশিয়ার গণমাধ্যমগুলো উল্লেখ করে ‘দোনেৎস্ক অঞ্চলের প্রবেশদ্বার’ হিসেবে। মস্কোর ভাষ্য, এই শহরটির মাধ্যমে রুশ সেনারা দোনেৎস্কে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা দুই শহর-ক্রামাতোরস্ক ও স্লোভিয়ানস্কে প্রবেশ করতে পারবেন। সে কারণেই এক বছরের বেশি সময় ধরে পোকরোভস্ক শহর দখলের হুমকি দিয়ে আসছিল রুশ বাহিনী। পোকরোভস্কের দখল নিতে দেড় লাখ সেনা একত্র করছে রাশিয়া। অপরদিকে রাশিয়া বলেছে, শহরটির পূর্বে ও উত্তর-পশ্চিম দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের বাহিনী। তারা ২৫৬টি ভবন দখল করে নিয়েছে। রুশ বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনের ১৯ শতাংশের বেশি অঞ্চল এখন তাদের দখলে, যা প্রায় ১ লাখ ১৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের সমান। অপরদিকে, ইউক্রেনের প্রকাশিত মানচিত্র অনুযায়ী, তাদের ১৯ দশমিক ১ শতাংশ ভূখ- এখন রাশিয়ার দখলে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাস পর ইউক্রেনের ১৮ শতাংশ অঞ্চল মস্কোর দখলে ছিল। মঙ্গলবার এমনই একটি ভিডিও প্রকাশ করেছেন যুদ্ধ নিয়ে কাজ করা রুশ ব্লগাররা। বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামের অনেক ব্যবহারকারী বলছেন, ভিডিওটি দেখে তাদের মনে হয়েছে, এটি যেন ১৯৭৯ সালের অ্যাকশনধর্মী হলিউড চলচ্চিত্র ‘ম্যাড ম্যাক্স’-এর একটি চিত্র।

এদিকে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভুসিক সতর্ক করে বলেছেন, পশ্চিমা দেশ এবং রাশিয়ার মধ্যে সরাসরি সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠছে। তার মতে, ইউরোপের দেশগুলোর দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি এবং অস্ত্রসজ্জার বৃদ্ধি এই পরিস্থিতিকে আরও নিশ্চিত করে তুলছে। মঙ্গলবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভুসিক বলেন, এমন যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন আর নিছক কল্পনা নয়। তিনি উল্লেখ করেন, সামরিক ব্যয়ের গতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার হুমকির কারণে দ্রুত সামরিকীকরণের পথে হাঁটছে, যদিও মস্কো এই বিষয়টিকে ঘরোয়া অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেওয়ার জন্য বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক বক্তব্য হিসেবে বাতিল করেছে। ভুসিক আরও বলেছেন, আমার ধারণা ইউরোপ এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি যুদ্ধ লাগবে, এই নিশ্চয়তাই বাড়ছে। তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। রোমানিয়া, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডের মতো ছোট দেশগুলোও একই পথে হাঁটছে, রাশিয়ানরাও তাই। তিনি বলেন, সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর ফল ীি হতে পারে? কেবলই সংঘাত। এই পরিস্থিতিতে, সার্বিয়াও নিজেকে একদিকে খাদ ও অন্যদিকে কূপের মাঝে মনে করছে এবং তাই সামরিক প্রস্তুতি জোরদার করতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। যদিও সার্বিয়া ইউরোপী কার্যতই স্থগিত রয়েছে। দুটি দেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক বজায় আছে এবং রাশিয়া সার্বিয়ার অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী। অন্যদিকে, মস্কো বারবার অভিযোগ করছে ন্যাটো এবং ইইউ ক্রমাগত সম্প্রসারণের মাধ্যমে ইউরোপে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, আগামীর যুদ্ধক্ষেত্র হবে মহাকাশ। বুধবার ফ্রান্সের মহাকাশ ও বিমান চলাচল কেন্দ্র তুলুসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন বলে খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি।

ম্যাক্রোঁ অভিযোগ করেন, ২০২২ সালে ইউক্রেনে আক্রমণ শুরু করার পর রাশিয়া মহাকাশ থেকে গুপ্তচর কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তার দাবি, বেশ কিছুদিন ধরেই রুশ মহাকাশ যানগুলো ফরাসি উপগ্রহগুলোকে পর্যবেক্ষণ করছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট আরও অভিযোগ করেছেন, ফরাসি মহাকাশ স্থাপনাগুলো ব্যাপক জিপিএস সিগন্যাল জ্যাম এবং সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। রাশিয়ার এ ধরনের কার্যকলাপকে হুমকি অভিহিত করে তিনি ফ্রান্সের সামরিক কার্যকলাপকে মহাকাশে বিস্তৃত করার ওপর জোর দেন। ম্যাক্রোঁ তার বক্তব্যে রাশিয়া মহাকাশে পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করছে বলে ইঙ্গিত দিয়ে এটাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য বিপর্যয় বলে উল্লেখ করেন। এর মোকাবিলায় ২০৩০ সাল পর্যন্ত মহাকাশ সামরিক খাতে অতিরিক্ত ৪.২ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার ঘোষণাও দেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট। তবে ঠিক কোন কোন বিষয়ে বিপুল এই অর্থ ব্যয় করা হবে, তার সুনির্দিষ্ট বিবরণ তিনি দেননি। ধারণা করা হচ্ছে, ফ্রান্সের মহাকাশ কৌশলের জন্য ভবিষ্যতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য লঞ্চার এবং উচ্চমাত্রার থ্রাস্ট ইঞ্জিন নির্মাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে।

ইউক্রেন যুদ্ধে প্রায় প্রতি রাতেই ব্যবহৃত হচ্ছে ড্রোন। এর পাশাপাশি ইউরোপের বিমানবন্দর এবং সংবেদনশীল স্থানগুলোর ওপর রহস্যময় ড্রোন অনুপ্রবেশের কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আর এতেই পরিষ্কার এখনও ড্রোন যুদ্ধের জন্য কিংবা এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত নয় ইউরোপ। এর ফলস্বরূপ, ইউরোপীয় নেতারা একটি ড্রোন প্রাচীর তৈরির পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছেন। এটি সেন্সর ও অস্ত্রের এমন একটি নেটওয়ার্ক যা অনুপ্রবেশকারী ড্রোনগুলোকে শনাক্ত, ট্র্যাক এবং নিরপেক্ষ করবে। রিগাতে, অরিজিন নামে একটি ছোট প্রযুক্তি কোম্পানি এই নতুন, উচ্চ-প্রযুক্তির যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রভাগে রয়েছে। তাদের সমাধান হলো ব্লেজ নামের একটি তিন ফুট লম্বা ইন্টারসেপ্টর ড্রোন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) সিস্টেম পরিচালিত এই ড্রোনটিকে শত্রু লক্ষ্যবস্তুকে চিনতে এবং তার কাছাকাছি উড়তে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এটি তখন একজন মানব অপারেটরকে সতর্ক করে দেয়, যিনি ইন্টারসেপ্ট করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন এবং একটি বোতাম চাপেন। এতে ২৮-আউন্সের একটি ওয়ারহেড বিস্ফোরিত হয়, ড্রোনটি নিজে ধ্বংস হয়ে যায় এবং আশা করা যায় এর লক্ষ্যবস্তুটিও ধ্বংস হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, পোকরোভস্ক থেকে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের কোনো গণপশ্চাদপসরণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়নি, এটি উপসংহারে পৌঁছানো যেতে পারে যে, শহরের বেশির ভাগ ইউক্রেনীয় রক্ষক দ্বারা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ একমাত্র উপলব্ধ পথ ধরে, মিরনোহরাদের পশ্চিমে চলে গিয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটি আশাহীন ছিল। ইতিমধ্যে, মিরনোগ্রাদের পূর্বাঞ্চল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। আরভিভোয়েনকোরি জানিয়েছেন যে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পোকরোভস্ককে রক্ষা করার জন্য এএফইউ ছয়টি ব্রিগেড মোতায়েন করেছে। তবে জেনারেল দ্রাপতিয়ের নেতৃত্বে পোকরোভস্কের দক্ষিণে ব্যর্থ পাল্টা আক্রমণে এই ব্রিগেডগুলো মূলত নির্মূল করা হয়েছিল।

ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ৯ কিলোমিটার দূরের ওবোলোন এলাকায় রাশিয়ার ট্যাংক চলতে দেখা গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, রাশিয়ার সৈন্যরা শহরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। কিয়েভ থেকে বিবিসির সংবাদদাতা পল অ্যাডামস টুইট করে জানান, গত ১০ মিনিটে কিয়েভে ছোট অস্ত্রের দুই দফা গুলির আওয়াজ শোনা গেছে। কী ঘটছে, বোঝা অসম্ভব।  পোকরোভস্ক নগর এলাকায় ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর শেষ প্রতিরক্ষারেখার পতন ঘটে এবং ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী প্রতিরোধ বন্ধ করে ত্রাণের অপেক্ষায় মিরনোরাড নগর এলাকায় ফিরে যায়। ১০ নভেম্বর, রাশিয়ান সামরিক চ্যানেল আরভিভোয়েনকোরি জানিয়েছে যে রাশিয়ান সশস্ত্র বাহিনী (আরএফএএফ) পোকরোভস্ক-মিরনোগ্রাদে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ অব্যাহত রেখেছে। ৯ নভেম্বর সন্ধ্যা নাগাদ, রাশিয়ান সেনাবাহিনী পোকরোভস্ক নগর এলাকার পূর্বে নাখিমভ স্ট্রিটে পৌঁছেছিল এবং একই সাথে রিভনে গ্রামে প্রবেশ করেছিল।