বরিশালে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করেছে। মশাবাহী এই রোগের ভয়াবহ বিস্তারে গত ২০ দিনে বিভাগের ছয় জেলায় অন্তত ২ হাজারের বেশি আক্রান্ত রোগী শানাক্ত হওয়াসহ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিদিনই অসংখ্য ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী আসায় চিকিৎসা দিতে শিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালগুলো।
শয্যাসংকটে হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা, এমনকি নার্সদের ডিউটি কক্ষেও রোগীদের রেখে চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। বিশেষ করে দেশের সর্বদক্ষিণের জেলা বরগুনায় বেশি মাত্রায় ডেঙ্গু আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার বরিশালে ডেঙ্গুর অতিরিক্ত প্রকোপ বৃদ্ধিতে চিকিৎসকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, বরিশাল অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। শুধু মে মাসে দুই হাজার ৮৪২ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা দেশের মোট রোগীর প্রায় ৪৪ শতাংশ। চলতি জুন মাসের ২০ দিনে রোগী পাওয়া গেছে ২ হাজার ১২১ জন এবং মারা গেছেন সাতজন। মে মাসের তুলনায় জুনে আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা বেশি।
এছাড়া চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ৩০ জনের এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৪৬৬ জন। এর মধ্যে রোগী বেশি বরিশাল বিভাগের বরগুনায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে প্রতিদিন ৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালটিতে পা ফেলার জায়গা নেই। কর্তৃপক্ষ রোগীদের জন্য ৫০ সিটের ব্যবস্থা করলেও পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ডে শয্যায় জায়গা না হওয়ায় চিকিৎসা চলছে ওয়ার্ডের মেঝেতে, নার্সদের কক্ষে ও বারান্দায়।
বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, আমতলী, বেতাগী, পাথরঘাটা, তালতলী, বামনা ও বরগুনা সদরসহ সবকটি উপজেলায় ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে।
সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে পাথরঘাটা উপজেলায়। এই উপজেলায় এ পর্যন্ত ৭৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। জানা গেছে, ১০ জন বা তার বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এ রকম ৩৬টি এলাকা চিহ্নিত করে জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়।
বরগুনা জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মো. রেজাওয়ানুর রহমান মুঠোফোনে রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘প্রতিদিনই রোগী আসছে, চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। হাসপাতালে শয্যা না থাকায় রোগীদের মেঝেসহ বিভিন্ন স্থানে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।
তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বরগুনায় বরাবরই ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি ছিল। ২০২২ সালে জেলায় ৪৮৫ জন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অনুরূপভাবে ২০২৩ সালে ভর্তি হয়েছিলেন চার হাজার ৫৯২ জন, এর মধ্যে মারা যান সাতজন। গত বছর ভর্তি হয়েছিলেন দুই হাজার ৪৩৪ জন, যার মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন চারজন।
বরগুনায় মশাবাহী রোগের ব্যাপক বিস্তারে চিন্তিত জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ আবুল ফাত্তাহ। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে জেলায় এবার রোগীর সংখ্যা বেশি, যা সবাইকে উৎকণ্ঠিত করে তুলেছে। এর নেপথ্য কারণ কী জানতে আইইডিসিআরের গবেষকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেই কারণসমূহ নিশ্চিত হওয়া সম্ভব, মন্তব্য করেন সিভিল সার্জন।
এদিকে বরগুনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী প্রতিদিন বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন। পরবর্তী সময়ে তাদের অধিকাংশই হাসপাতালে ভর্তি থাকছেন।
শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, একসাথে অধিকসংখ্যক ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শয্যাসংকটের কারণে অনেকে মেঝেতে অবস্থান নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করছেন।
এই তথ্য নিশ্চিত করে শেবাচিম হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. এস এম মনিরুজ্জামান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘চিকিৎসা দিয়ে কোনোভাবেই ডেঙ্গু প্রতিরোধ সম্ভব নয়। এ জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত, মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, মশাকে কোনোভাবেই বাসাবাড়ির আশপাশে আবাসস্থল গড়তে দেওয়া যাবে না।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ৪৫০ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে বুধবার পর্যন্ত মোট চিকিৎসা নিয়েছেন তিন হাজার ৭৫ জন রোগী। এর মধ্যে মারা গেছেন আটজন। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন দুই হাজার ৬৬০ জন। বাকিরা চিকিৎসাধীন।
বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডলও এই রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অনুরূপ পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ‘বরিশাল বিভাগে গত বছরের চেয়ে এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী বেড়েছে, যা নিয়ে সর্বদা টেনশনে থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে বরগুনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের খবর পাওয়া যাচ্ছে।’
‘এই রোগ থেকে নিস্তার পেতে হলে জনসাধারণকে সচেতন হওয়া জরুরি। এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী সবার চলা উচিত। বিশেষ করে বাসাবাড়ির আশপাশে ফুলের টবে যাতে কোনো পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এবং ঘরের চারদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে এডিস মশাকে আবাসস্থল ধ্বংস করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে।’
আপনার মতামত লিখুন :