স্বপ্ন এমন অমোঘ সত্য, যা শত পরিচয় থাকা সত্ত্বেও মানুষকে সতন্ত্র পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। ঠিক তেমনি এক স্বপ্নবাজ নারী মিমোষা লিমু হাওলাদার। বাবা চাকরিজীবী, স্বামী জনপ্রিয় ব্যান্ড আর্টসেলের ভোকাল, তবু তিনি নিজের পরিশ্রমে গড়ে তুলতে চান নিজস্ব পরিচয়। সেই লক্ষ্যে প্রায় আট বছর কঠোর পরিশ্রমের পর প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘টগস বাই লিমু’ নামের নিজস্ব ব্র্যান্ড। স্বপ্ন দেখছেন, একদিন তার ব্যবসা দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারেও পৌঁছাবে। এই স্বপ্নবাজ নারী উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলেছেন আরফান হোসাইন রাফি
স্বপ্ন থেকে শুরু
ছোটবেলা থেকেই আমার চাকরি করার প্রতি কোনো আগ্রহ ছিল না। মনে মনে সব সময় ভাবতাম, একদিন আমি উদ্যোক্তা হবো। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ব্যবসায় উদ্যোগ বইতে রণদাপ্রসাদ সাহার আত্মজীবনী পড়েছিলাম। সেই গল্প আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। তখন থেকেই ব্যবসার স্বপ্ন আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। স্বপ্নের টানে আমি প্রায়ই বাবা-মাকে বলতাম, জুতার দোকান বা কাপড়ের দোকান দিতে। কিন্তু তখনকার সময়ে নিজে কিছু করব এ সুযোগের সীমাবদ্ধতা ছিল। আমাদের প্রজন্ম তখনো অনলাইন নির্ভর হয়ে ওঠেনি, তাই ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হয়নি। তবে স্বপ্নটা ধরে রেখেছিলাম, অবশেষে বিয়ের পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মাত্র চার হাজার টাকা নিয়ে আমি ব্যবসার পথচলা শুরু করি। আমার অনলাইন শপের প্রথম নাম ছিল ‘মিমোষাস ইউটোপিয়া’। নামটি দিয়েছিলেন আমার স্বামী। ইউটোপিয়া শব্দের অর্থ স্বপ্নরাজ্য (সম্ভবত গ্রিক শব্দ থেকে এসেছে)। আমার স্বপ্নপূরণের যাত্রা শুরু হচ্ছে ভেবে তিনি নামটি বেছে নিয়েছিলেন। সেখানে আমি সামর্থ্য অনুযায়ী প্রথমে বেছে নিই জুয়েলারি এবং বাংলাদেশি ব্যাগ। চকবাজারে আমার এক বন্ধুর হোলসেল দোকান ছিল, সেখান থেকেই আমি প্রোডাক্ট সংগ্রহ করে অনলাইনে বিক্রি শুরু করি।
পারিবারিক সাপোর্ট
শুরু থেকেই আমার বাবার বাড়ি এবং শ্বশুরবাড়ির সবার পূর্ণ সমর্থন পেয়েছি। কারণ সবাই জানতেন, এটা আমার স্বপ্ন, আমি ব্যবসা করতে চাই। স্বপ্নপূরণের পথে পরিবার সব সময় আমার পাশে থেকেছে, যা আমাকে এগিয়ে যেতে শক্তি জুগিয়েছে।
সংগ্রাম থেকে সাফল্য
আমার সন্তান হওয়ার পর ব্যবসায় সময় দেওয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তবু আমি কখনোই ব্যবসাটা বন্ধ করিনি। যতটুকু পারতাম, ততটুকু দিয়েই ব্যবসা চালিয়ে গেছি। প্রেগন্যান্সির সময় সবাই অসুস্থ থাকে, আমি আরও বেশি অসুস্থ ছিলাম, কিন্তু ব্যবসার কাজ থামাইনি। ফার্মগেটের বাসা থেকে আশপাশের জিনিস কিনে ফেসবুকে পোস্ট করতাম। কখনো দুই-তিন মাসে একটা অর্ডার আসত, আর সেই অর্ডার পেয়ে আমি ভীষণ খুশি হতাম। তবে সন্তানকে কখনো অবহেলা করিনি। বাচ্চাকে কোলে নিয়েই কাজ করতে হয়েছে, বাজারে যাওয়া-আসা করতে হয়েছে। এতে শরীর ভেঙে যেত, গরমে বাচ্চারও কষ্ট হতো। তখন ভাবলাম, বাড়ি বসে এমন কিছু করা যায় কি না, যাতে ব্যবসাও চলে আর সন্তানেরও কষ্ট না হয়। তারপর আমি হোমমেড প্রোডাক্ট নিয়ে প্রায় এক বছর পড়াশোনা করি। এরপর নিজের জন্য একটি অর্গানিক হেয়ার অয়েল তৈরি করে কৌতূহলবশত ফেসবুকে পোস্ট করি। অবাক হয়ে দেখি, প্রথম দিনেই প্রচুর মানুষ সাড়া দিলেন। সে দিনই আমাকে প্রায় দুই লিটার তেল বানাতে হয়েছিল বিক্রির জন্য। এভাবেই অর্গানিক প্রোডাক্ট ব্যবসার যাত্রা শুরু হলো। ঘরে বসেই প্রোডাক্ট বানাতে পারছিলাম, ডেলিভারি দিতে পারছিলাম, আর সন্তানের যতœও নিতে পারছিলাম। পরে আমি পূর্ব রাজাবাজারে ‘ঈধৎব ড়ভ ঘধঃঁৎব’ নামে একটি আউটলেট খুলি। তবে শুধু হেয়ার অয়েল দিয়ে দোকান চালানো সম্ভব হচ্ছিল না। তাই ক্লোদিংসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক পণ্যও যুক্ত করি। আউটলেটটি ছিল ছোট, গলির ভেতরে, আর সেখানে নানা সমস্যা দেখা দেয়। সাইনবোর্ড চুরি হয়ে যাওয়া, বৃষ্টিতে দেয়াল ও ফার্নিচার নষ্ট হওয়া! সবকিছু মিলিয়ে ব্র্যান্ড ভ্যালু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখান থেকে সরে গিয়ে সেজান পয়েন্টের চারতলায় নতুন আউটলেট নেই। তারপর ব্যবসার ধরন অনুযায়ী দোকানের নাম পরিবর্তন করে রাখলাম ‘টগস বাই লিমু’। আমাকে আজকের এ অবস্থানে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি ব্যবসায়ে স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছি, তবে তার নাম বা অন্য কারো পরিচয় ব্যবহার করে ব্যবসা বাড়াইনি। একেবারেই নিজের পরিশ্রম আর ধৈর্যের ফলেই এ জায়গায় পৌঁছেছি।
আর্থিক সহায়তা
আমার জীবনে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর জন্য আমি অনেক পরিশ্রম করেছি। ধীরে ধীরে নিজস্ব পুঁজি গুছিয়েছি। তবে আউটলেট চালানোর ক্ষেত্রে প্রধান অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছি আমার শাশুড়ীর কাছ থেকে। তার চাকরি জীবনের শেষ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা তিনি আমার ব্যবসার জন্য দিয়েছেন। এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিগুলোর একটি। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে অ্যাডভান্সের ক্ষেত্রে বাবাও আমাকে সাহায্য করেছেন। তবু প্রোডাক্ট কেনার দায়িত্ব সম্পূর্ণ নিজেই নিয়েছি। এ সহায়তার কারণে আমি স্থিতিশীলভাবে ব্যবসা চালাতে পেরেছি।
স্বতন্ত্র পরিচয় গঠন
সমাজ সাধারণত নারীদের দুভাবে চিহ্নিত করে, বিয়ের আগে বাবার, বিয়ের পরে স্বামীর পরিচয়ে। কিন্তু আমি ছোট থেকেই একজন স্বতন্ত্র মানুষ হতে চেয়েছি এবং সব সময় আত্মনির্ভরশীল থাকতে পছন্দ করেছি। নিজে পরিশ্রম করে যে পরিচয় অর্জন করব, তার অবশ্যই একটি মূল্য আছে। আমি চাই না বাবার বা স্বামীর নামের সহায়তায় কিছু করি; বরং আমি বিশ্বাস করি, নিজের কষ্ট এবং পরিশ্রমে তৈরি পরিচয় মানুষ বেশি মনে রাখবে।
দেশীয় পোশাক
এখন বিদেশি পোশাকের যুগ! মানুষ বিদেশি পোশাকে বেশি ঝুঁকছে, অথচ দেশের নিজস্ব তাঁত ও পোশাক অনেক সমৃদ্ধ। তাই আমি দেশীয় পোশাকের ওপর কাজ করি। আমার চ্যালেঞ্জ হলো কীভাবে মানুষকে দেশীয় পোশাকে আকৃষ্ট করা যায়। এ উদ্যোগে আমি আড়ং, দেশি দশ এবং অন্যান্য দেশীয় ব্র্যান্ড থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছি। আমাদের পেজের ট্যাগলাইনও এ রকম
‘দেশীয় পোশাক পরিধান করি, দেশের অর্থনীতি তরান্বিত করি।’ আমার বিশ্বাস, দেশের উন্নতি তখনই সম্ভব যখন আমরা নিজস্ব দেশকে সমর্থন করি। কেউ এক দিনে বড় হয় না; আজকের সব বড় ব্র্যান্ডও ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। আমি বিশ্বাস করি, কোয়ালিটি ধরে রেখে আমি একদিন মূল্যবান ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারব।
সামাজিক প্রতিবন্ধকতা
নারীদের ব্যবসায়ে সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কিছুটা থাকবেই। যখন আমি ব্যবসা শুরু করি, অনেকেই বলত ‘ এত পড়াশোনা করেছো, এই অনলাইন ব্যবসা করে কী হবে।’ বা ‘এটা কোনো পেশা কি?’ এরকম মন্তব্য শুনতে হতো। উদ্যোক্তা মানেই একসময় ছোট করে দেখা হতো। তবে তখন যারা এমন বলেছে, তারাও কোথাও না কোথাও আজ ব্যবসা বা পেশাজীবনে জড়িত। এ ছাড়া আমার সবচেয়ে বেশি শুনতে হতো ‘ওর স্বামী তো সেলিব্রিটি, ওর কোনো কষ্টই করতে হয় না!’ এ ধরনের মন্তব্য আমাকে খুব কষ্ট দিত। তবে এসব সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আমাকে থামায়নি; বরং আরও দৃঢ় করে আমাকে এগিয়ে যেতে।
পরামর্শ
নতুন উদ্যোক্তাদের আমি বলব, অনেক ধৈর্য রাখতে হবে। আমার জীবনে অনেক বাধা ও বিপদ এসেছে, তবে আমি কখনো ধৈর্য হারাইনি। এ ছাড়া ব্যবসা কখনো সিজনাল হওয়া উচিত নয়। ব্যবসায় পূর্ণ মনোযোগ ও মনোভাব রাখতে হবে। লাভ-লোকসান উভয়ই থাকবে, কিন্তু ধারাবাহিক পরিশ্রম ও ধৈর্যই সাফল্যের চাবিকাঠি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
একজন উদ্যোক্তা হিসেবে আমি নিজেকে এমনভাবে দেখতে চাই, যে আমার ব্যবসা শুধু বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং দেশের বাইরে ছড়িয়ে পড়বে। আমি স্বপ্ন দেখি, ‘টগস বাই লিমু’ ব্র্যান্ডটি আন্তর্জাতিক বাজারেও পৌঁছাবে এবং বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে পরিচিত হবে।