অনার্সে ভর্তির সময়টি একজন শিক্ষার্থীর জীবনে এক নতুন যাত্রার সূচনা। উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে পা রাখার এই মুহূর্তটি শুধু উচ্চশিক্ষার দিকে অগ্রসর হওয়ার নয়; বরং নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ভিত্তি রচনার সময়ও বটে। অনেকের স্বপ্ন সরকারি উচ্চপদে চাকরি করা, বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করা। কিন্তু বিসিএস নামক প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষার প্রস্তুতি কি অনার্স শেষ করে শুরু করলেই যথেষ্ট? বাস্তবতা হলো, না। বরং অনার্সে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সুপরিকল্পিত ও কৌশলগত প্রস্তুতি শুরু করলে বিসিএসের পথ অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
প্রথম বর্ষ-দ্বিতীয় বর্ষ
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ সাধারণত নতুন পরিবেশ, নতুন বন্ধু, নতুন স্বাধীনতায় ভরা থাকে। কিন্তু এই সময়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি তৈরির সময়।
বিসিএসের প্রস্তুতি দীর্ঘমেয়াদি; তাই প্রথম বর্ষ থেকেই নিজের লক্ষ্য পরিষ্কার করে নেওয়া জরুরি। লক্ষ্য পরিষ্কার থাকলে (এড়ধষ পষধৎরঃু) পড়াশোনায় গতি বাড়ে, সময় নষ্ট কম হয়। প্রতিদিন ঠবৎু ংসধষষ ংঃবঢ়ং গ্রহণ যেমন : ২০-৩০ মিনিট সাধারণ জ্ঞান পড়া বা ইংরেজি সংবাদ পড়া, দীর্ঘমেয়াদে বড় পরিবর্তন আনে।
বেসিক তৈরি
বিসিএস প্রিলিমিনারি ও লিখিত উভয় পরীক্ষায় বাংলা, ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত, বাংলাদেশ বিষয়াবলি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের ভালো ভিত্তি থাকা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দুই বছরই এই বেসিক তৈরির সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
বাংলা ও ইংরেজিতে দক্ষতা
বিসিএসে বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ৮০-১০০ নম্বর থাকে। অথচ বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই এ বিষয়ে দুর্বলতা অনুভব করে। তাই প্রতিদিন ১৫-২০ মিনিট সংবাদপত্র পড়া, গ্রামার ও শব্দভা-ার চর্চা, যেকোনো বিষয় নিয়ে ছোট প্যারাগ্রাফ লেখার অভ্যাস নিয়মিত করলে ইংরেজি-বাংলায় দুর্দান্ত উন্নতি এনে দেয়।
সাধারণ জ্ঞানের বেস
ইতিহাস, ভূগোল, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধানÑ এসব বিষয়ে এনসিইআরটি ধাঁচের বই পড়া শুরু করলে পরবর্তীতে বিসিএস প্রস্তুতিতে চাপ কমে যায়। প্রতিদিন অল্প করে যা শেখা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসের টাইমলাইন, সংবিধানের মৌলিক অনুচ্ছেদ, মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সাম্প্রতিক বিশ্বপরিস্থিতির সারসংক্ষেপ, এই জ্ঞান ধপপঁসঁষধঃরড়হ-ই ভবিষ্যতে বড় প্রতিযোগিতায় আপনার শক্তি হয়ে দাঁড়াবে।
তৃতীয় বর্ষ
এই বর্ষে এসে শিক্ষার্থী বুঝতে পারে, সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। অনেকেই এই সময় থেকে কোচিং, প্রশ্নব্যাংক ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি হলো, নিজের বেস যেখান থেকে দুর্বল ছিল তা ঠিক করা।
সাপ্তাহিকভাবে প্রিলিমিনারি প্রশ্ন সেট সমাধান করা। প্রফেশনাল লেখার স্টাইল তৈরি করা (ইঈঝ ৎিরঃঃবহ ংশরষষং)। এ ছাড়া এ সময়ে পরিকল্পনা খুব জরুরি। প্রতিদিন ২ ঘণ্টা পড়লেও যদি সেটি ধারাবাহিক হয়, তবে ফল অনেক ভালো হয়।
চতুর্থ বর্ষ
চতুর্থ বর্ষ প্রিপারেশনকে ধারালো করার সময়। চূড়ান্ত বর্ষে এসে অনেকেই থিসিস ও কোর্সের চাপে ডুবে যায়, ফলে বিসিএস প্রস্তুতি পিছিয়ে যায়। কিন্তু একটু কৌশলী হলে দুটোই সামলানো সম্ভব। সকাল বা রাতের শেষ দিকের সময় এক-দেড় ঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, প্রিলিমিনারি মডেল টেস্টে অংশ নেওয়া, লিখিত প্রস্তুতির জন্য নোট সাজানো, প্রতিদিন সংবাদ ও বিশ্লেষণ পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। এ সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পড়হংরংঃবহপু। অল্প পড়া হলেও নিয়মিত পড়া, এই এক অভ্যাস শত প্রতিযোগীর ভিড়েও আপনাকে এগিয়ে রাখবে। এছাড়াও বিসিএস কেবল বই পড়ে পাস করার বিষয় নয়; বাস্তব দক্ষতাও এখানে সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই, যোগাযোগ দক্ষতার জন্য প্রেজেন্টেশন ও সেমিনারে অংশ নেওয়া, ক্লাব কার্যক্রমে যুক্ত হওয়াÑ এসব নেতৃত্ব ও যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ায়, যা মৌখিক পরীক্ষায় কাজে আসে। প্রযুক্তি ও ডিজিটাল দক্ষতার জন্য টাইপিং স্পিড, ডেটা হ্যান্ডলিং, বেসিক সফটওয়্যার (ডড়ৎফ, ঊীপবষ, চড়বিৎচড়রহঃ)Ñ এসব দক্ষতা ভবিষ্যৎ পেশাজীবনে অপরিহার্য। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এগুলো শেখা খুব সহজ। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য সাহিত্য, ইতিহাস, জীবনী, নন-ফিকশনÑ এসব বই নিয়মিত পড়লে জ্ঞানের গভীরতা বাড়ে, চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়।
বিসিএসের জন্য সহায়ক সাবজেক্ট
যদিও বিসিএস পরীক্ষায় সব বিভাগের শিক্ষার্থীই সমান সুযোগ পায়। তবে কিছু বিষয় রয়েছে, যা প্রস্তুতিকে তুলনামূলক সহজ করে তোলেÑ বাংলা বা ইংরেজি বিভাগ : ভাষা, ব্যাকরণ, রচনা, সাহিত্যÑ এসব বিষয়ে গভীরতা থাকায় লিখিত পরীক্ষায় বড় সুবিধা পাওয়া যায়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান : বাংলাদেশ বিষয়াবলি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থাÑ এসব বিসিএসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
অর্থনীতি : অর্থনীতি, বাজেট, উন্নয়নÑ এসব নিয়ে বিসিএসে প্রশ্ন থাকে, পাশাপাশি উচ্চতর পদেও এই জ্ঞান কাজে আসে।
আইন : সংবিধান, আইনব্যবস্থা, মৌলিক অধিকারÑ এসব সম্পর্কে ধারণা শক্তিশালী হলে লিখিত ও ভাইভায় বেশ সুবিধা মেলে।
ইতিহাস : বাংলাদেশ ও বিশ্ব ইতিহাসের ওপর দক্ষতা থাকা বিসিএসের বড় অংশকে সহজ করে দেয়।
লেখক : প্রভাষক, বিক্রমপুর আদর্শ কলেজ

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন