তিন বছর পর মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানি বাড়ছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা কলকারখানা স্থাপনে আগের চেয়ে অধিক পরিমাণ যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলছেন। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বর) নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানা সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোতে ৪৭ কোটি ১৭ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৩ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি করে উদ্যোক্তারা সাধারণত নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণ করে থাকেন। অর্থাৎ, শিল্প খাতে বিনিয়োগ বাড়ে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে গতি আসে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া চলতি ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য সব মিলিয়ে ১ হাজার ৭৯৬ কোটি ৬৭ লাখ (প্রায় ১৮ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ৪৭ কোটি ১৭ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে; এই অঙ্ক গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের চেয়ে ২২ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানিসংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, টানা তিন অর্থবছর ধরে দেশে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে। মহামারি করোনাভাইরাস সৃষ্ট দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার বছর, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির জন্য দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ এলসি খোলা হয়। ওই অর্থবছরে আমদানির মোট পরিমাণ দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯১৬ কোটি (৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন) ডলার। এক বছরে বিশাল অঙ্কের আমদানির ভার নিতে পারেনি বাংলাদেশ। আর তাতে দেশে ডলারের তীব্র সংকট দেখা দেয়। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কমতে থাকে; ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নেমে আসে ২০ বিলিয়ন ডলারে। ২০২১-২২ অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ৬০০ কোটি (৬ বিলিয়ন) ডলারের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয় দেশে। এরপর থেকে দেশের সামগ্রিক আমদানি কমার পাশাপাশি মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক ধাক্কায় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা কমে ৫৫ দশমিক ০৯ শতাংশ। আর এলসি নিষ্পত্তি কমে ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
এর পরের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির এলসি খোলা ও নিষ্পত্তি কমে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৯৭ ও ২৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোতে ১৭৪ কোটি ৫৪ লাখ (১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খোলেন, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৫ দশমিক ৪১ শতাংশ কম। গত অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ১৯৮ কোটি ৫১ লাখ (১ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন) ডলার; কমেছিল প্রায় একই, ২৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ২৩৪ কোটি (২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন) ডলার; নিষ্পত্তির পরিমাণ ছিল ২৬৬ কোটি ১৬ লাখ (২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরও শুরু হয় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি নিয়ে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ কম মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হয়। তবে দ্বিতীয় মাস আগস্টেই প্রবৃদ্ধিতে ফেরে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ২৬ কোটি ৪১ লাখ ৫০ হাজার ডলারের এলসি খোলা হয়, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চেয়ে একই সময়ের চেয়ে ২৬ কোটি ২২ লাখ ৭০ হাজার ডলার বা দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।
সেপ্টেম্বর শেষে অর্থাৎ, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সেই প্রবৃদ্ধি এক লাফে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এই তিন মাসে নতুন শিল্পকারখানা স্থাপন বা কারখানার সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য দেশের বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোতে ৪৭ কোটি ১৭ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩৮ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পরপর দুই মাস (আগস্ট ও সেপ্টেম্বর) রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনান্ড ট্রাম্প আমাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ওপর অনেক বেশি শুল্ক আরোপ করায় চীনের অনেক অর্ডার বাংলাদেশে আসছে। সেই অর্ডার বা কার্যাদেশ ধরতে পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা নতুন কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন; একই সঙ্গে বিদ্যমান কারখানা সম্প্রসারণেরও পরিকল্পনা করছেন। সে কারণে তারা মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে হলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্টের সার্বিক চিত্রে উন্নতি হয়েছে। অবস্থা অনেকটা স্বস্তিদায়ক দেখা যাচ্ছে। চলতি ও আর্থিক হিসাবে উদ্বৃত্তও দেখা যাচ্ছে। এর পেছনে যে ঘটনা, সেখানে কিছু ইতিবাচক কারণ আছে; আবার নেতিবাচক কারণও আছে। ইতিবাচকের মধ্যে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি ছিল। তার চেয়ে বড় কারণ ছিল রেমিট্যান্সের উল্লম্ফন। এ কারণে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন