ভদ্রলোক দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললেন, ‘তোমাাদের দেশের সাংবাদিকরা ভাগ্যবান।’
ভাগ্যবান! সাংবাদিকরা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। নিজেদের ভাগ্য যে ভালো সেটা তো তারা নিজেরাও জানেন না।
জট খুলতে একজন প্রশ্ন করলেন, ‘ভাগ্যবান বলছ, বিষয়টা একটু ভেঙে বলবে।’
‘সাংবাদিকতার কত সুযোগ। সাংবাদিকতার জন্য বাংলাদেশ অসাধারণ জায়গা।’
এরপর আর চুপ থাকা যায় না। দলবেঁধে প্রতিবাদ, ‘কোথায় সাংবাদিকতার সুযোগ...তুমি তা হলে জানো না... এখানে একটা খবর কর্তৃপক্ষের পছন্দ না হলে...’
প্রায় প্রত্যেকেরই সাংবাদিকতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার নানা স্মৃতি মনে পড়ে যায়। কেউ গাল খেয়েছেন। কেউ মার। কেউ মামলা। কেউ শাসানি।
ভদ্রলোক তবু হাসছেন, ‘আমি সেসব বলছি না। আমি বলছি, তোমাদের দেশে কত ঘটনা। এই খুন হচ্ছে। এই রাজনৈতিক নেতা হুঙ্কার দিচ্ছেন। এই বাস দুর্ঘটনা তো এই বিল্ডিংয়ে আগুন। ইংল্যান্ডে আমাদের যেসব ঘটনার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়, এখানে সেটা প্রতিদিন।’
ভদ্রলোকের নাম শিল্ড বেরি। প্রখ্যাত ইংলিশ লেখক এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড সিরিজ কভার করতে এসেছিলেন ২০০৩ কি ০৪ সালে। প্রেসবক্সে ইংরেজি পত্রিকা দেখে তার এই বিশ্লেষণটা শুনতে শুনতে মনে হলো, আরে তাই তো!, এভাবে দেখলে বাংলাদেশ তো সাংবাদিকতার দারুণ জায়গা। সবসময় ঘটনা। উত্তেজনা। অপরাধ। রাজনৈতিক হুঙ্কার। হানাহানি।
ফলে তিনি ঠিক। আবার আমরা যা বললাম তা-ও তো ঠিক। অদ্ভুত এক মিশ্রতা এবং পরস্পরবিরোধিতা। ইন্টারেস্টিং।
আরও একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার গত কয়েক বছরে খেয়াল করলাম। যে মানুষগুলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সবচেয়ে সোচ্চার থাকে তারাই আসলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় সবচেয়ে বড় বাধা।
৫ আগস্টের আগে কিছু মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই বলতেন, ‘সাংবাদিকতা করে কী লাভ? সাংবাদিকরা তো স্বাধীন না। কিছুই তো লিখতে পারে না। বলতে পারে না।’
কথাটা অনেকাংশে ঠিক বলে খুব প্রতিবাদ করা যেত না।
৫ আগস্ট এলো। এলো নতুন পরিস্থিতি। এখন আবার অন্য একদল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। যারা বলে, ‘খুব তো স্বাধীনতা দেখছি। সবই তো সরকারি সাংবাদিকতা। সরকার যা বলে, তাই।’
এই কথাও অনেকাংশে ঠিক। কাজেই খুব প্রতিবাদ এখনও করা যায় না। মজাটা হলো, এই মানুষগুলোই আগের ১৫ বছর বলত, সংবাদমাধ্যম দারুণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। এবং এখন প্রায় একই রকম পরিস্থিতিতে তারা মনে করছেন সংবাদ মাধমের স্বাধীনতা নেই। আবার, এখন যারা সংবাদমাধ্যম নজিরবিহীন স্বাধীনতা ভোগ করছে বলছে মনে করেন তারা আবার তখন মনে করতেন, সাংবাদিকদের কোনো স্বাধীনতা নেই।
পার্থক্য কি নেই? আছে, তখন সংবাদ বিরুদ্ধে গেলে আপনি হতেন যুদ্ধাপরাধীর দোসর। এখন হচ্ছেন, ফ্যাসিস্টের দোসর এবং এক আমলে যারা ট্যাগের বিরোধিতা করেন অন্য আমলে তারাই ট্যাগ দেন। এক আমলে যারা স্বাধীন সাংবাদিকতা শেখান আরেক আমলে তারাই স্বাধীনতার পথ রোধ করেন।
মুশকিল এবং মজা আরও আছে। যারা সংবাদমাধ্যম নিয়ে কথা বলেন, তারা প্রায় সবাই ফেসবুকে লেখালেখি করেন। মোটামুটি কোনো না কোনো পক্ষের এক্টিভিস্ট এবং চান স্বাধীন সংবাদমাধ্যম তিনি বা তারা যা লিখেন সবাই সেভাবেই লিখুক। কিন্তু একেবারে তাদের সঙ্গে একমত হলেও একটা মিডিয়ার সম্ভবই না তাদের মতো করে বলা। কারণ তাকে কিছু ব্যাকরণ মানতে হয়। আপনি শুনেই ফেসবুকে লিখে দিতে পারেন, ওখানে আগুন লেগেছে বা অতজন মারা গেছে। কিন্তু মিডিয়াকে অন্তত কোনো না কোনো সূত্র থেকে খবরটা নিশ্চিত করতে হবে। অথবা কোনো একজন দায়িত্বশীলকে বলতে হবে। ফলে যে দেরি হয়, এটুকুও সইতে রাজি না এখনকার ‘নিরপেক্ষ’ বোদ্ধারা। অদ্ভুত প্যারাডক্স হলো, সংবাদমাধ্যমকে নিরপেক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয় সাধারণত সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্টুদের কাছে। আর তাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরিস্থিতিটা হলো এমন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আমরা সবাই চাই কিন্তু সেই মতটা হতে হবে আমার পক্ষে। সাংবাদিককে নিরপেক্ষ হতে হবে তবে আমার পক্ষে থাকতে হবে এবং মজাটা এখানেই শেষ নয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় সলতেতে আগুন দেওয়ার কাজটা যারা করেন তাদেরও পরিচয় সাংবাদিকই।
এখন সাংবাদিকরা সাংবাদিকতা বাদ দিয়ে রাজনীতিক বা রাজনীতিকদের সহযোগী হয়ে উঠছেন। দলীয় ভিত্তিতে ইউনিয়ন ভাগ করছেন। সেই পরিচয়জাত সাংবাদিকতা করছেন। বিপক্ষকে ঘায়েল করতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে আসলে সবার আগে দায়টা নিজেদের কাঁধেই আসে। সময় এসেছে আয়নায় নিজেদের দাঁড় করানোর। এক আমলে সব অন্যায় সমর্থন করব, আরেক আমলে বিরাট প্রতিবাদী হয়ে যাবÑ এটা দলীয় রাজনীতিকদের মানায়। সাংবাদিকদের নয়। আর কেউ কেউ এই কাজটা করে বলেই সামগ্রিকভাবে সাংবাদিক আর সাংবাদিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। হচ্ছে।
সাংবাদিকতার জন্য বেদনার বিষয় হলো, এই ধারার সাংবাদিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয় কিন্তু রাজনৈতিক শক্তির জোরে তারাই থাকে সামনে। তাদের দিয়েই সাংবাদিকতাকে দেখে মানুষ এবং তার ভিত্তিতেই যখন বিচার করে তখন মানুষকে কী দোষ দেবেন! সে যাদের দেখছে তাদের যতটা রাজনীতি করতে দেখছে ততটা সাংবাদিকতা নয়। ফলে, আড়ালে থাকছে সেই সিংহভাগ সাংবাদিক, যারা আজও বিশ^াস করে সততা আর সত্যের পথে থাকাই সাংবাদিকতা। অকারণে তারাও আক্রান্ত। ক্ষতিগ্রস্ত।
পরিত্রাণের উপায়! ওটাই। আরও সঠিক সাংবাদিকতা করা। গণতন্ত্রের সমস্যা যেন গণতন্ত্রের চর্চা দিয়ে সমাধান করতে হয়, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তাই। সাংবাদিকতার সমস্যা আরও ভালো সাংবাদিকতা দিয়ে দূর করতে হবে। শুধু এই ক্ষেত্রেই নয়, হাওয়াই-ভাইরালিজম প্রতিরোধের উপায়ও সত্যিকারের সাংবাদিকতা। তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো ফল মিলবে না, বা পিছিয়েই পড়তে হবে কিন্তু সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় সম্বল বিশ^স্ততা। নির্ভরতা। সেটার জন্য সময় লাগে। আর লাগে ধৈর্য। সত্যিকারের সাংবাদিকতার এখন বহুমুখী পরীক্ষার সময়।
এই কঠিন সময়ে রূপালী বাংলাদেশ পূরণ করল এক বছর। পরিচিতদের অনেকেই কাজ করে। পত্রিকাটি দেখি এবং দেখতে পাই তাদের চেষ্টা। ভিন্নভাবে সংবাদ সাজানোর ধরন দৃষ্টি আকর্ষণ করে। খবর বের করার একটা তৎপরতাও আছে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে নতুন সংবাদমাধ্যমের কাজ অনেক কঠিন, ছাপা পত্রিকার ক্ষেত্রে তো হিমালয়জয়তুল্য কাজ, কিন্তু জেনেও যারা এই কাজে নামে প্রথমেই তারা সাহসের জন্য কিছু পয়েন্ট পাবে। আর সোশ্যাল মিডিয়া আবার একদিকে সুবিধা। আগে জনপ্রিয় বা বড় না হলে সেই পত্রিকার খবর মানুষ পর্যন্ত পৌঁছাত না, এখন বিষয়টা তেমন নয়। একটা ভালো খবর, নতুন বা কম পরিচিত মাধ্যমে প্রকাশিত-প্রচারিত হলেও ফেসবুক-টুইটারের কল্যাণে ঠিক পৌঁছে যায় হাতে হাতে।
সংকট আছে। সেটা সবাই দেখতে পায়। সম্ভাবনা? খুঁজে নিতে হয়। শুরুর যে গল্পটা বলছিলাম সেটা এজন্যই যে খালি চোখে অনেক সুবিধাই আমরা দেখতে পাই না। কেউ কেউ দেখে।
যারা দেখে তারা টিকে থাকে। যারা চোখ বুজে থাকে তারা পথ হারায়।
রূপালী বাংলাদেশের চোখটা খোলাই দেখতে পাচ্ছি।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন