দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার আমদানি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে। নতুন বছরের জন্য সরকার রপ্তানি ও প্রবাস আয় বাড়ানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও আমদানির লক্ষ্য কমিয়ে আনতে চায়। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, নতুন অর্থবছরের জন্য সরকার রপ্তানি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ৪৮ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। যা চলতি বছর আছে ৬১ বিলিয়ন ডলার, তবে সংশোধিত বাজেটে তা ১৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন কমিয়ে ৪৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ১২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার কম ও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বেশি নির্ধারণ করা হতে যাচ্ছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার প্রবাসী আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ৩১ বিলিয়ন ডলার। যা চলতি বছর আছে ২৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার, তবে সংশোধিত বাজেটে তা ২৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার কম ও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি নির্ধারণ করা হতে যাচ্ছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সরকার আমদানি লক্ষ্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে ৭১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। যা চলতি বছর আছে ৬৮ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার, তবে সংশোধিত বাজেটে তা ৬৬ দশমিক ৪ বিলিয়ন নির্ধারণ করা হয়েছে। এই হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটের তুলনায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার কম ও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৫ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বেশি নির্ধারণ করা হতে যাচ্ছে।
এদিকে গত ৩ অক্টোবর রপ্তানি নীতি ২০২৪-২৭-এর খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এতে এ মেয়াদের শেষ বছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১০ বিলিয়ন ডলার। এ নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে রপ্তানি প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আমদানি-রপ্তানির মধ্যে ভারসাম্য আনা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা।
এ ছাড়াও রপ্তানি বাণিজ্যের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ়করণে রপ্তানি নীতির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বিকাশকে উৎসাহিত করতেও সহায়ক।
অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে, রপ্তানিকারকদের উৎসাহিত করতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক প্রণোদনার বিকল্প ব্যবস্থা-সংক্রান্ত নির্দেশিকা এবং রপ্তানিতে নারী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা সুপারিশ করা হয়েছে।
রপ্তানি প্রক্রিয়ায় বেশ কয়েকটি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাতে সম্ভাবনাময় নতুন কিছু পণ্য ও সেবা, যেমন সবজি, হস্ত ও কারুপণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ উন্নয়নমূলক খাতে স্পিনিং ও ফেব্রিক উৎপাদন ও ডাইং-প্রিন্টিং ফিনিশিং অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত সেবা খাত ও বিশেষ উন্নয়নমূলক সেবা খাটের প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
রপ্তানি সম্প্রসারণে সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যবস্থা ঠিক করা হয়েছে। এতে খাতভিত্তিক কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। ওষুধশিল্প ও চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং হস্তশিল্পজাত পণ্যকে নতুনভাবে এ অংশে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সেবা খাতের রপ্তানি সম্প্রসারণে সহায়ক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি নতুন অধ্যায় সংযোজন করা হয়েছে।
‘রপ্তানি নিষিদ্ধ পণ্য তালিকা’ এবং ‘শর্তসাপেক্ষে রপ্তানি পণ্য তালিকা’ হালনাগাদ ও এইচএস হেডিংসহ উল্লেখ করা হয়েছে। রপ্তানি-সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন কমিটি এবং রপ্তানি-সংক্রান্ত কারিগরি কমিটির পঠন ও কার্যপরিধিও এই নীতিমালায় সন্নিবেশ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে অন্তর্বর্তী সরকার পোশাকশিল্পে চলমান অস্থিরতা, দেশের কয়েকটি স্থানে বন্যা ও আন্তর্জাতিক সংকটের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে। আর সরকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং বিশ্বাস করে যে চলমান পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।
গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিগগিরই ব্যবসায়ীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবে বলে আশা করেন ওই কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছরের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অবাস্তব নয়। তবে এ লক্ষ্য অর্জনে জ্বালানি সরবরাহের পাশাপাশি লজিস্টিক, বন্দর ও পরিবহন সেবা মসৃণ হতে হবে। বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার আস্থা ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো করতে হবে।
একই মত প্রকাশ করেছেন রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক। তিনি বলেন, ‘এই লক্ষ্যমাত্রা খুবই বাস্তবসম্মত।’ গত বছরের রপ্তানি আয় কত কম ছিল তা বিবেচনায় নিয়ে ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন সহজ। তা ছাড়া সাধারণত এক বছর কম অর্জনের পর পরের বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশি হয়। তাই রপ্তানি এই মুহূর্তে ধীর হলেও নতুন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত ও অর্জনযোগ্য।
আপনার মতামত লিখুন :