আগামী বছর রমজান শুরুর আগের সপ্তাহেও নির্বাচনের আয়োজন করা যেতে পারে। নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এমন অবস্থান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব কমে আস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের নেতারা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, নির্বাচনের জন্য এটি উপযুক্ত সময় এবং সরকারের এমন অবস্থান সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন এনসিপির নেতারা।
তাদের দাবি, একটি নির্দিষ্ট দলকে খুশি করতেই এমন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। গতকাল শুক্রবার লন্ডনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকের প্রতিক্রিয়ায় এসব মন্তব্য করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচনের জন্য এটি উপযুক্ত সময়।
সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারের আপসের মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে। একই সঙ্গে, রাজনৈতিক সংকট নিরসনে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই, সেটিও স্পষ্ট হলো।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের জন্য ডিসেম্বর, জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারি যে উপযুক্ত সময়, তা সরকার উপলব্ধি করে আমলে নিয়েছে। এটি জনগণ এবং সব রাজনৈতিক দলের জন্য ভালো দিক।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে বৈঠকে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে বাংলাদেশ সময় গতকাল বিকেল ৪টায় উভয় পক্ষের প্রতিনিধিরা যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানান।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান, প্রেস সচিব শফিকুল আলম, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন।
গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকের মধ্য দিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে গেছে।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, জাতি এই বৈঠকের অপেক্ষায় ছিল। বৈঠকটি টার্নিং পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। নির্বাচন ইস্যুতে তারেক রহমানের প্রস্তাব ছিল। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এই বৈঠক প্রমাণ করে, সংকটের মধ্যেও মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।
রমজান শুরুর আগে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আগামী বছর রমজান শুরুর আগে নির্বাচন আয়োজন নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। এর মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের দাবির প্রতিফলন হয়েছে। এটি জাতির আকাঙ্ক্ষা ।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা এই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে অগ্রগতির কথা বলেছেন। তবে নির্দিষ্ট করে কোন সংস্কারগুলো করবেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট করেননি। সংস্কার দৃশ্যমানের দায় সরকারের, কোনো রাজনৈতিক দলের নয়।
মৌলিক সংস্কার ও বিচারব্যবস্থাকে সক্রিয় করবে সরকার। তিনি আরও বলেন, দেশে স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে যেতে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন বা ভোট প্রয়োজন, সেটি আয়োজন করতে হবে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, সব রাজনৈতিক দলের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে দলের চেয়ে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমরা যেন নিজের দলীয় স্বার্থের জন্য এমন দিকে না যাই, যাতে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ফেব্রুয়ারি নয়, ডিসেম্বরের মধ্যেই সব ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ ও বিচার সম্পন্ন করে নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তা না হলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা কাটবে না। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণার বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখতে চাই।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠকের ফলে দুই পক্ষই জিতেছে। উভয় পক্ষের মধ্যে থাকা বিভক্তি, সন্দেহ ও অবিশ্বাস কমেছে। নাটকীয় কিছু না ঘটলে এই ঐকমত্য দেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, এ দুই নেতার বৈঠকটি ইতিবাচক। তবে নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। এর পাশাপাশি সংস্কার ও বিচারের বিষয়েও আলোচনা এবং অগ্রগতি জরুরি।
আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক অংশীজনদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছেন, দেশের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে আলাপ করছেন। এটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক। নির্বাচনের ব্যাপারে আমরা বরাবরই প্রধান উপদেষ্টার ওপর আস্থাবান ছিলাম যে উনি ওয়াদার খেলাপ করবেন না।
তারই ধারাবাহিকতায় উনি এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। আমরা বারবার বলেছি যে, নির্বাচনের তারিখ নিয়ে দূরত্ব খুবই সামান্য এবং সেটা আলাপ-আলোচনা করে কমিয়ে আনা যাবে।
জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও যুগপৎ নেতৃত্বের নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকটটি ইতিবাচকভাবে দেখছি।
দেশ ও জনগণের কথা চিন্তা করে তাদের আলোচনার মাধ্যমে ভোট গ্রহণের সময় এপ্রিল থেকে সরে ফেব্রুয়ারি নির্ধারণ করতে পেরেছেন এটাকে সাধুবাদ জানাই।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, একটি রাজনৈতিক দলকে খুশি করার জন্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে আনা হচ্ছে, যা জুলাইয়ের শহিদদের সঙ্গে প্রতারণা।
তিনি বলেন, সংস্কার আর বিচারকে পাশ কাটিয়ে সরকার যে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে, তা ১৮ কোটি মানুষের নির্বাচন হবে না। এমনভাবে নির্বাচনের দিকে গেলে আরেকটা ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে। জনগণ আবারও গণঅভ্যুত্থানে যেতে বাধ্য হবে।
তিনি আরও বলেন, বিদেশের মাটিতে বসে যখন সরকার বিশেষ দলের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে বসে, তখন এটা হয়ে যায় গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি।
আপনার মতামত লিখুন :