সুস্থ হওয়ার পরও জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের হাসপাতালে থাকা নিয়ে জল ঘোলা কম হয়নি। বিশেষ করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (পঙ্গু হাসপাতাল) এবং জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ও হাসপাতালকে (এনআইও) দিনের পর দিন দখলে রাখার অভিযোগ উঠেছে বারবার।
তবু হাসপাতাল ছাড়তে নারাজ তারা। জুলাই ঘোষণাপত্র না হওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল ছাড়বেন না তারা। এর একমাত্র কারণ হিসেবে নিজেদের নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করছেন তারা। ভাতার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের চাহিদা সবারই। চান বাসস্থানের সুবিধাও।
ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম শঙ্কিত অবস্থায় দিন পার করা চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের একজন মোহাম্মদ আল মিরাজ বলেন, ‘যদি জুলাই ঘোষণাপত্র না হয়, তাহলে ২০ বছর বা তারও পরে কোনো দিন যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তাহলে আমাদের ধরে ধরে ফাঁসি দেবে। নিজেদের বিভিন্ন অঙ্গের বিনিময়ে দেশ থেকে ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করেছি। এখন সরকারের কাছে আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিই করছি। আর তো কিছু না।’
১৬ দিন বন্ধ থাকার পর গত বৃহস্পতিবার চালু হয় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ও হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা। এদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, আজ শনিবার থেকে পূর্ণাঙ্গভাবে চিকিৎসাসেবা চালু হবে। কিন্তু হাসপাতালের ভেতরে এখনো জুলাই আহতদের ৪০ জন অবস্থান করছেন। ঈদের ছুটির কারণে কিছু আহত ছাড়পত্র না নিয়েই বাড়ি গেলেও যেকোনো সময়েই তারা ফিরে আবারও আন্দোলন শুরু করে দিতে পারেন। তাই শঙ্কিত খোদ হাসপাতালটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালকও।
রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে এসেছেন। তাদের কিছু দাবিদাওয়া আছে। এসব নিশ্চিত করলে তারা নিয়মিতই আসবেন। তবে অধিকাংশ চিকিৎসক, নার্স ও স্টাফদের নিরাপত্তার শঙ্কা এখনো কাটেনি।
হাসপাতালে অবস্থান করা জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিরা আমাদের কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। তাই আমরা এখনো তাদের মতিগতি বুঝতে পারছি না।
তবে রূপালী বাংলাদেশকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী জুলাইয়ে আহত মোহাম্মদ আল মিরাজ বলেন, ‘সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়ে আমি দেশে ফিরে আসি গত মাসে। এক চোখ দিয়ে আমি দেখি না। ডান চোখে এখনো বুলেট আছে। এটা বের করলে চোখের আকৃতি নষ্ট হয়ে যাবে।
তাই সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকেরা এটি বের করা যাবে না বলে জানিয়েছেন। তাদের চিকিৎসায় বাম চোখে ৪০ শতাংশ দেখি। দুই থেকে তিন হাত দূরত্বে মানুষ দেখি। কিন্তু সিঙ্গাপুর থেকে আসার পর হঠাৎ করে ব্যথা উঠলে এখানে আসি। ঈদের ছুটির আগে এখানে জুলাই আন্দোলনে আহত ৫৪ জন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।
তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া অন্য সবাই হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি চলে গেছেন। বাকি যারা রয়েছেন, তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এদের অনেকেরই বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি, কিন্তু সরকার থেকে নির্দিষ্ট কয়েকজনকে ছাড়া পাঠানো হচ্ছে না।
সরকার চাইলে এক বিমানে করে সবাইকে পাঠাতে পারে। কিন্তু সেটি না করে সময়ক্ষেপণ করছে। আমরা তো মুক্তিযোদ্ধাদের মতো সুবিধাপ্রাপ্য। তাদের যেমন সুবিধা দেওয়া হয়, আমাদের কেন দেওয়া হবে না? এদিকে জুলাই ঘোষণাপত্রও হচ্ছে না। এটি না হলে কোনো সময় যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন আমাদের ধরে ধরে ফাঁসি দেবে।’
হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, স্বল্প পরিসরে সেবা চালু হলেও হাসপাতাল ভবনের চতুর্থ তলা এখনো দখলে রেখেছেন জুলাই আহতরা। তাদের কয়েকজন চতুর্থ তলার কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে ভেতরে অবস্থান করছেন।
তাদের মধ্যে একজন মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘আমার বিদেশে চিকিৎসা নেওয়া জরুরি। সরকারকে বারবার বলার পরও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাহলে আমরা আন্দোলন করব না তো কী করব?’ একই অভিযোগ করেন রবিন খান নামের আরেক আহত।
তিনি বলেন, ‘সরকার যাদের মনে করছে তাদের বিদেশ পাঠিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনছে। আমরা কী দোষ করেছি? আমাদেরও তো সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।’
একই দাবি পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদেরও। এমনকি তারা নানান সময়ে দাবি আদায়ে হাসপাতালের কর্মীদের সঙ্গে মারামারিতেও জড়িয়েছেন।
মামুন আহমেদ নামক এক আহত শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আহত হয়েছি। কিন্তু এই হাসপাতালের কর্মীদের কাছে যেন আমাদের কোনো মূল্যই নেই। প্রায়ই তারা আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে। সরকারও আমাদের কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
আমরা দিনের পর দিন বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ কাউকে কাউকে তো বিদেশে পাঠানো হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। আমাদের কেন পাঠানো হবে না? আমাদেরও তো সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার রয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্রও হচ্ছে না। তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কী?’
এসব প্রসঙ্গে জানতে পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘যেসব রোগীকে বিদেশে চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন, তাদের সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে। অনেককে আবার বিদেশি চিকিৎসকেরা এসেও চিকিৎসা দিয়েছেন।
আমরা আমাদের চেষ্টার ত্রুটি করছি না। যার যে চিকিৎসা প্রয়োজন, তাদের সেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে। তবু তাদের মধ্যে যদি কোনো অসন্তুষ্টি থাকে, তাহলে আমাদের কী করার আছে বলেন?’
প্রসঙ্গত, গত ২৫ মে দুপুরে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে একটি বৈঠক চলাকালে সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া ও অবহেলার অভিযোগ এনে বিষ পান করেন সেখানে চিকিৎসাধীন চার জুলাইযোদ্ধা।
বিষপানকারীরা হলেন- শিমুল, মারুফ, সাগর ও আখতার হোসেন (আবু তাহের)। পরে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তারা সবাই শঙ্কামুক্ত। কিন্তু ওই ঘটনায় জুলাই আহতরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই এমনটা করেছেন বলেও অভিযোগ করছেন অনেক চিকিৎসক।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা সবার সুচিকিৎসার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। তার পরও কিছু কিছু আহতের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা করছি। সবার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু পুনর্বাসন বা জুলাই ঘোষণাপত্রের সিদ্ধান্ত তো সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হাতে। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু করার নেই।’
আপনার মতামত লিখুন :