ইরানের ওপর গত ১৩ জুন শুক্রবার প্রথম হামলা করে ইসরায়েল। এরপর উভয়পক্ষের মধ্যে টানা ১২ দিন ধরে চলে তুমুল রক্তক্ষয়ী সংঘাত। প্রথমে এই যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করলেও গত শনিবার ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র।
এতে এই যুদ্ধ আঞ্চলিক গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক রূপ নেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছিল। যুদ্ধের এমন প্রেক্ষাপটে গত সোমবার রাতে কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় ইরান।
প্রায় কাছাকাছি সময়ে ইরাকে অবস্থিত মার্কিন আই আসাদ ঘাঁটিতেও হামলার খবর জানা যায়। ঠিক এমন অবস্থার মধ্যেই ওয়াশিংটনের সময় অনুযায়ী সোমবার সন্ধ্যা ৬টার কয়েক মিনিট পর নিজের সোশ্যাল মিডিয়া ট্রুথ সোশ্যালে এক পোস্টে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লিখেন, ইসরায়েল ও ইরান পুরোপুরি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
ট্রাম্পের বক্তব্য অনুসারে, যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ইরান-ইসরায়েল উভয় দেশই এই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
তবে ইতিমধ্যে এই যুদ্ধবিরতির কার্যকারিতা নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলের সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে, যুদ্ধবিরতির পরও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে ইরান। যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করায় হামলায় তেহরান কাঁপবে বলে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন ইসরায়েলের দুই মন্ত্রী।
অন্যদিকে ইসরায়েলের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ইরান বলেছে, নতুন করে কোনো আগ্রাসন হলে জবাব দেওয়া হবে। এদিকে যুদ্ধবিরতির শর্ত মেনে ইরানে বোমা না ফেলতে ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তারপরও ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলায় ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেছেন ট্রাম্প। গতকাল মঙ্গলবার ন্যাটো সম্মেলনে অংশ নিতে নেদারল্যান্ডস যাওয়ার পথে এয়ার ফোর্স ওয়ান বিমানে সাংবাদিকদের এ কথা জানান ট্রাম্প। সবমিলিয়ে দুই দেশের যুদ্ধবিরতি আপাতদৃষ্টিতে দৃশ্যমান হলেও এর স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা রয়েই যাচ্ছে।
পাল্টাপাল্টি হামলায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে উদ্বেগ: ইরান-ইসরায়েলের সংঘাত শুরু হওয়ার নবম দিনের মাথায় ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরান কী জবাব দিবে তা নিয়ে যখন নানা বিচার-বিশ্লেষণ চলছিল, এর মধ্যেই গত সোমবার কাতার ও ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। ইরানের এই হামলার যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্য তথা বিশ্বব্যাপী যুদ্ধের শঙ্কা তীব্র হচ্ছিল তখনই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুথ সোশ্যালে ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতিতে সম্মতির ঘোষণা দেন।
তবে গতকাল মঙ্গলবার যুদ্ধবিরতির পরও ইরান থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করার দাবি করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করেছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। পাশপাশি ইসরায়েলের জনগণকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে। তবে হামলার বিষয়ে ইরানের পক্ষ থেকে কিছু জানানো হয়নি।
তবে এসব ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের বিবরণ এখনো স্পষ্ট নয়। এ ছাড়া ইরানও আক্রমণের বিষয়টি নিশ্চিত করেনি। ইসরায়েল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ার কথা বলার পর এসব ক্ষেপণাস্ত্র এসেছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
ইরানের এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ বলেছেন, ইরান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এর জবাবে তেহরানের কেন্দ্রে ইরানের সরকারি স্থাপনায় জোরালো হামলা করতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সামাজিক মাধ্যম এক্সে হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখেছেন, ‘তেহরান কাঁপবে’।
অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াল জমির ইরানকে কঠোর জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ইরানের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধবিরতির গুরুতর লঙ্ঘনের’ অভিযোগ তুলে এ হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
তবে ইসরায়েলের এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ আবদুল রহিম মুসাভি দাবি করেছেন, গত কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেহরান ইসরায়েলের দিকে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েনি। এর আগে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছিল, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর ইরান ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে বলে যে খবরটি প্রকাশ হয়েছে তা মিথ্যা।
অন্যদিকে আগ্রাসন হলে জবাব দেওয়া হবে জানিয়ে এক বিবৃতিতে ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল বলেছে, পরবর্তী সময়ে যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরান একটি সিদ্ধান্তমূলক, দৃঢ় ও সময়োপযোগী প্রতিক্রিয়া দেখাবে। বিবৃতিতে কাউন্সিল ইরানি জনগণের সচেতনতা, স্থিতিস্থাপকতা এবং ঐক্যের প্রশংসা করে বলেছে যে, ‘শত্রুদের পরাজয়’ ইরানিদের ‘দৃঢ় সংকল্প, কৌশলগত ধৈর্য ও অপমান বা একতরফা আপস মেনে নিতে অস্বীকৃতির’ ওপর নির্ভরশীল।
এদিকে ইরানে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ওপর অত্যন্ত বিরক্ত বলে জানা গেছে। সম্ভবত তিনি মনে করছেন, নেতানিয়াহু ‘বিশ্বাসভঙ্গ’ করছেন। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি ফিল লাভেল এ কথা জানান।
ইউরোপে ন্যাটো সম্মেলনে যোগ দিতে রওনা হওয়ার আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প জানান, যুদ্ধবিরতির শর্ত ঘোষণার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা লঙ্ঘন করায় তিনি ইসরায়েল ও ইরানÑ দুই পক্ষের প্রতিই ক্ষুব্ধ।
আলজাজিরার প্রতিনিধি লাভেল বলেন, ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরানÑ উভয়ের ওপরই ক্ষুব্ধ ছিলেন। তবে তার অতিরিক্ত রাগটা যে ইসরায়েলের দিকে ছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
ইরানের রাজধানী তেহরানে সর্বশেষ চালানো হামলা নিয়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর বিবৃতি দিয়ে বলেছে, ইরানের আগের কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে যুদ্ধবিরতির ‘লঙ্ঘন’ হিসেবে অভিহিত করে ইসরায়েল তেহরানের কাছে একটি রাডার স্থাপনা ধ্বংস করেছে।
আলজাজিরার খবরে বলা হয়, ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপের পর নেতানিয়াহু ‘নতুন করে কোনো হামলা চালানো থেকে বিরত আছেন’।
যুদ্ধবিরতির আগে ও পরে দুদেশের পাল্টাপাল্টি হামলা: যুদ্ধবিরতির পরও ইরান থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত করার দাবি করেছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রতিহত করেছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। পাশাপাশি ইসরায়েলের জনগণকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।
ইরানের এই হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় রাজধানী তেহরানে হামলা চালায় ইসরায়েল। ইসরায়েলের হামলায় তেহরানের কাছে একটি রাডার স্থাপনা ধ্বংস করা হয়। এদিকে ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর বাবলসারের কাছে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।
ইরানি সংবাদ সংস্থা ইরনার বরাত দিয়ে আলজাজিরা এ কথা জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যক্ষদর্শীরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। ওই এলাকায় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় হয়েছে।
এদিকে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলের বিরসেবা শহরে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে চারজনে পৌঁছেছে। ইসরায়েলের চ্যানেল১৪ এ খবর জানিয়েছে। অগ্নিনির্বাপক ও উদ্ধারকারী কর্মকর্তার বরাতে চ্যানেলটি এ খবর জানিয়েছে। খবর আলজাজিরার।
এর আগে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল ও ওয়াইনেট নিউজের বরাতে তিনজন নিহত হওয়ার খবর জানায় আলজাজিরা। অন্যদিকে ইরানের রাজধানী তেহরানের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ভোরের দিকে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ইরানের আধা সরকারি তাসনিম সংবাদমাধ্যমের বরাতে এ খবর জানিয়েছে সিএনএন।
হামলার বেশকিছু ছবি যাচাই করে সিএনএন বলছে, তেহরানের মধ্যাঞ্চলের আকাশে কালো ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। তেহরানের উপকণ্ঠে মেহরান আর ডিস্ট্রিক্ট ৬ এলাকার বাসিন্দাদের নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে নির্দেশনা দিয়েছিল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। এর পরই তেহরানে হামলার খবর পাওয়া গেল। এ ছাড়া ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তেহরানের ডিস্ট্রিক্ট ৭ এলাকার বাসিন্দাদেরও সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।