এই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা রক সংগীতের এক অবিস্মরণীয় চরিত্র, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গিটারিস্ট, গায়ক, সুরকার ও গীতিকার আইয়ুব বাচ্চু। আজ তার ৬৪তম জন্মবার্ষিকী। তিনি শুধু একজন সংগীতশিল্পী ছিলেন না; ছিলেন এক আন্দোলন, এক প্রেরণা- বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের ইতিহাসে যার নাম লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে।
১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট চট্টগ্রামের পটিয়ার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন আইয়ুব বাচ্চু। সংগীতের পথে যাত্রা শুরু চট্টগ্রামের রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হওয়া এই তরুণের জন্য সহজ ছিল না। কৈশোরে ব্রিটিশ ও আমেরিকান রক মিউজিকের প্রেমে পড়েন তিনি। এরপর মাত্র ১৬ বছর বয়সে ব্যান্ড ‘সোলস’-এ যোগ দেন, যেখানে তিনি প্রথম গান করেন ‘হারানো বিকেলের গল্প’।
সোলসে থাকাকালীন (১৯৮০–১৯৮৯) বাংলা ব্যান্ড সংগীতের ভুবনে নিজের অবস্থান শক্ত করেন তিনি। ১৯৮৬ সালে মুক্তি পায় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’। এরপর ১৯৮৯ সালে আসে ‘ময়না’- এবং তার একক ক্যারিয়ার শুরু করে এক অসাধারণ যাত্রা।
১৯৯০ সালে নিজের ব্যান্ড গঠন করেন আইয়ুব বাচ্চু। শুরুর দিকে নাম ছিল Yellow River Band (YRB)। পরে একটি আন্তর্জাতিক কনসার্টে ভুল করে ব্যান্ডের নাম লেখা হয় Little River Band (LRB)। যদিও এটি অস্ট্রেলিয়ান একটি ব্যান্ডের নাম, তবুও সেই নামই রয়ে যায়- তবে সম্পূর্ণ নতুন অর্থে: Love Runs Blind।
এলআরবি-র হাত ধরেই আসে বাংলাদেশের প্রথম ডাবল অ্যালবাম ‘এলআরবি-১’ ও ‘এলআরবি-২’। এরপর একের পর এক যুগান্তকারী অ্যালবাম- ‘সুখ’, ‘তবুও’, ‘ঘুমন্ত শহরে’, ‘ফেরারী মন’, ‘স্বপ্ন’, ‘মনে আছে নাকি নেই’, ‘যুদ্ধ’ প্রভৃতি- তাকে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের আইকনে পরিণত করে।
আইয়ুব বাচ্চুকে নিয়ে জনশ্রুতি তৈরি হয়েছে বহু। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়টি নিউইয়র্কের একটি গিটার সেন্টার নিয়ে- যেখানে কাচের বাক্সে থাকা দামি গিটার বাজাতে দেওয়া হয়নি তাকে, শুধুমাত্র বাংলাদেশি পরিচয়ে। কিন্তু গিটার হাতে পেতেই বাচ্চু বাজাতে শুরু করেন, আর অবাক হয়ে যায় সবাই। পরে সেন্টার কর্তৃপক্ষ নিজে থেকে গিটারটি অর্ধেক দামে দিতে চেয়েছিল। এই ঘটনা বাচ্চুর গুণমুগ্ধ শ্রোতাদের কাছে আজ বাংলাদেশের এক সম্মানের প্রতীক।
গানের কথা: বাচ্চুর গানে ছিল হৃদয়ের ভাষা, যন্ত্রণার সুর, ভালোবাসার গভীরতা- ‘সেই তুমি’, ‘কষ্ট’, ‘রুপালি গিটার’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘আরও বেশি কাঁদালে’ আজও মানুষের মুখে মুখে।
গিটার বাজানো: তার গিটারের শব্দ যেন ছিল আত্মার ভাষা। কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশের এরিক ক্ল্যাপটন ছিলেন তিনি।
সংগীত চেতনা: তিনি শুধু রকার ছিলেন না, ছিলেন একজন সুরস্রষ্টা। ‘বনলতা সেন’-এর মতো সাহিত্যনির্ভর গানকে যেভাবে গিটারে রূপ দিলেন, তা চিরস্মরণীয়।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি ভালোবাসা: নতুন শিল্পীদের সাহস জুগিয়েছেন, প্ল্যাটফর্ম দিয়েছেন, পিতৃসম হাত রেখেছেন মাথায়।
২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে আইয়ুব বাচ্চু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর খবরে শোকাহত হয়ে পড়ে পুরো দেশ। জেমস কনসার্টে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘বাচ্চু নেই, এটা বিশ্বাস করতে পারছি না’।
আজ তার জন্মদিনে দাঁড়িয়ে, আমরা বুঝতে পারি- তার শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও, তিনি রয়েছেন আমাদের গানে, গিটারে, অনুভবে, ভালোবাসায়।