রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে গিয়ে বেশ কিছু বিষয়ে ঐক্য হলেও শেষ অবধি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছে না দেশের রাজনৈতিক দলগুলো। যদিও ‘সকল রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে অবস্থান সমান নয়। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে যদি একইভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ঐকমত্য আসবে না বলেই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ফলে ঐকমত্যের পদ্ধতিগত বিষয়ে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে সরকারের সামনে।’ জুলাইয়ের বর্ষপূর্তি হতে চললেও এখনো ঐকমত্যে পৌঁছতে না পারলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। তারপরও দেশের মানুষ সংস্কার, ঐকমত্য ও জুলাই সনদের দিকে তাকিয়ে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন সরকারের হাতে এসেছে আগেই।
ঐকমত্য কমিশন এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার মাঝপথে। সব বিষয়ে একমত হতে না পারায় ধারাবাহিক সংলাপ চলছেই। দেড় ডজন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মধ্যে ৯টি বিষয়ে ইতিমধ্যে মতামতও নিয়েছে কমিশন। যাত্রা শুরুর তিন মাসের মাথায় রাষ্ট্র সংস্কারের পথনকশা ঠিক করতে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন করে দেয় সরকার। সব কয়টি সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন জমা দিলেও আক্ষরিক অর্থে সংস্কার দৃশ্যমান না হওয়ায় হতাশ দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি।
১ জুলাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, বড় দল হিসেবে বিএনপি সবচেয়ে বেশি ছাড় দিয়ে যাচ্ছে, যাতে সবগুলো দল নির্বাচনমুখী হয়। যদিও নতুন করে পিআর (প্রোপোরশনেট রিপ্রেজেনটেটিভ) সিস্টেমে নতুন বাঁক নিয়েছে রাজনীতিতে।
রাজনীতির মাঠে এখন নতুন আলোচনা পিআর। নির্বাচনী তারিখ নিয়ে যখন কিছুতেই কাটছে না সংকট, তখন পিআর কিংবা সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থা নিয়ে সংকটে নতুন মেরুকরণ বলছেন রাজনীতিকরা। পিআর নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য এখন বেশ স্পষ্ট। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল মনে করে, জনগণের সরাসরি ভোটে যাদের নির্বাচিত হওয়ার সামর্থ্য নেই, তাদের পক্ষ থেকে ছলচাতুরী করে সংসদে যাওয়ার জন্য এই সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচনের ধুঁয়া তোলা হচ্ছে।
অন্যদিকে পিআর পদ্ধতিতে যারা নির্বাচন দাবি করছে তারা মনে কওে, গতানুগতিক সরাসরি ভোটের নির্বাচনে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব কখনোই নিশ্চিত হবে না বলে মনে করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার অপকৌশল এসব। উত্তরাঞ্চলে এনসিপি নেতারা কৌশলে তাদের নির্বাচনি শোডাউন দিয়ে যাচ্ছেন। আর মুখে মুখে বলছেনÑ এটা না হলে আমরা নির্বাচনে যাব না, ওটা না হলে নির্বাচনে যাব না।
এরই মধ্যে রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার আগে প্রথম পর্বে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে দুই মাস সময় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা বৈঠক করেছিল কমিশন।
প্রথম পর্বে যেসব মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে এই পর্বে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। দ্বিতীয় পর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের এখন পর্যন্ত ৯ দিন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়েছে। এর আগের পাঁচ দিনে আলোচনা হয়েছে ৯টি বিষয়ে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি দলগুলো। বিএনপি নেতারা এই বৈঠককে অন্তঃসারশূন্য বলে মনে করলেও শেষ দেখার অপেক্ষায় চালিয়ে যাচ্ছেন বৈঠক।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় পর্বে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দলগুলোর সঙ্গে মোট ২০টির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার প্রস্তুতি আছে। তবে কমিশন এই সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। আলোচনায় অগ্রগতি সাপেক্ষে প্রয়োজনে আরও বিষয় যুক্ত করা হবে।
এরই মধ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, বিরোধী দল থেকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা, ১০০ নারী আসনে সরাসরি ভোট, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কত সময় প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন) এবং সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে আলোচনা হলেও, রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে হয়নি ঐকমত্য, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নিয়ে ঐকমত্য হয়েছে অনেক দলেই। তবে বাকি বিষয়গুলো আলোচনার টেবিল থেকে এখনো বাদ দেওয়া হয়নি। সেগুলো নিয়েও ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা অব্যাহত আছে, আরও আলোচনা হবে।
এই আলোচনা কত দিন চলবে, তা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়নি। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাইয়ের মধ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করার লক্ষ্য রয়েছে কমিশনের। অবশ্য ইতিমধ্যে কোনো কোনো দলের মুখে এই আলোচনা নিয়ে হতাশা ফুটে উঠেছে।
এমনকি ঐকমত্য কমিশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রীয়াজও কখনো হতাশা প্রকাশ করে আবার দেখেছেন আশার আলো। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ্উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সব বিষয়ে একমত হলে তো আর সংলাপ প্রয়োজন হতো না। আলোচনার মাধ্যমে মতানৈক্যের সমাধান খুঁজছেন তিনি।
তবে এনসিসি নিয়ে জোর আপত্তি বিএনপির। ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে এবং এক ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা যাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে না যায়, সে জন্য সংবিধানে যেসব সংস্কার আনার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার একটি হলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন। প্রস্তাব অনুযায়ী নির্বাহী বিভাগ, আইনসভা ও বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রের এই তিনটি অঙ্গের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এনসিসি গঠিত হবে।
নির্বাচন কমিশন (ইসি), পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ (পিএসসি) বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধানদের নিয়োগের জন্য এই কাউন্সিল রাষ্ট্রপতির কাছে নাম পাঠাবে। রাষ্ট্রপতি তাদের নিয়োগ দেবেন। বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে অন্য যেকোনো কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করতে হয়।
এনসিসি গঠন করা হলে সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমবে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ অনেক দল নীতিগতভাবে এ প্রস্তাবকে সমর্থন করে। তবে এনসিসির গঠনপ্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা আছে। অন্যদিকে বিএনপি, সিপিবি, গণফোরাম, বাসদসহ কিছু দল এই প্রস্তাবের সঙ্গে একমত নয়। বিশেষত এনসিসি নিয়ে বিএনপির জোরালো আপত্তি আছে। তারা মনে করে, এনসিসি গঠন করা হলে প্রধানমন্ত্রী পদের গুরুত্ব কমে যাবে। সরকার হবে দুর্বল।
এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রিত্বের মেয়াদ, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ নিয়ে এখনো আলোচনা চলমান। সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ১০০টি করা এবং এসব আসনে সরাসরি ভোট দেওয়ার প্রস্তাব করেছে সংবিধান ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।
যে প্রক্রিয়ায় জাতীয় ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তাতে কতটা ঐকমত্য হবে, তা নিয়েও সংশয়ের কথা এসেছে। এখানে কিছু কিছু দল একবারে নিজেদের অবস্থানে অনড়। যদি এভাবে চলতে থাকে, কেয়ামত পর্যন্ত কোনো ঐক্যের সম্ভাবনা দেখি না বলে মন্তব্য করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু সাংবাদিকদের বলেন, তিন দিন ধরে ব্যাপক আলোচনা-বিশ্লেষণ চলছে, কিন্তু কোনো বিষয়েই ঐকমত্য হচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত যত সময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তার তুলনায় ফল কম হলেও ঐকমত্য কমিশন আশাবাদী। আলী রীয়াজ বলেছেন, এখন পর্যন্ত আলোচনায় যে অগ্রগতি, কমিশন আরেকটু বেশি অগ্রসর হবে এবং দলগুলো আরেকটু বেশি ছাড় দেবে বলে আশা করি। আগামীতে জাতীয় স্বার্থে দলগুলো প্রয়োজনে কিছুটা ছাড় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবে এবং দ্রুত একাধিক বিষয়ে ঐকমত্য হবে বলে আশা করছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাকে সংস্কার বলা যায় না। সব দলকে নিয়ে বেশির ভাগ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যে কঠিন কাজ। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে অবস্থান সমান নয়। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে যদি একইভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ঐকমত্য আসবে না।