ঢাকা বুধবার, ১৬ জুলাই, ২০২৫

বৃষ্টি কমে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি, বেড়েছে দুর্ভোগ

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২৫, ১১:৩৮ পিএম

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন জেলা। তবে বৃষ্টি কমায় অন্য জেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও বাড়ছে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি। ফলে নদীতীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এদিকে, ফেনীর নদ-নদীর পানি কমলেও নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু এলাকা। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির সংকট। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা অনেকে বলছেন, তারা এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি। এদিকে, নোয়াখালীতে বৃষ্টি কমলেও অধিকাংশ এলাকা জলাবদ্ধ থাকায় ভোগান্তি কমেনি। রূপালী বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট :
ফেনী : বৃষ্টি কমায় জেলার পশুরাম, ফুলগাজীসহ বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কমেছে নদ-নদীর পানি। জেলার অনেক জায়গা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। তবে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে বেশ কিছু এলাকা। পরিস্থিতির উন্নতি হলেও আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা অনেকে বলছেন, এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের সহযোগিতা পাননি।
জেলা আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, গত বুধবার দুপুর ১২টা থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলায় ৫০ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত দুই দিনের চেয়ে কম। তবে ফেনী-পরশুরাম আঞ্চলিক সড়ক ডুবে থাকায় তৃতীয় দিনের মতো ছোট-বড় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ফেনী জেলা সদরের সঙ্গে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার সড়কপথ দিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (উচ্চ পর্যবেক্ষক) মজিবুর রহমান বলেন, গত দুই দিনের তুলনায় আজ (বৃহস্পতিবার) বৃষ্টি কম হয়েছে। এ কারণে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
এদিকে গতকাল দুপুর ১২টায় মুহুরী নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢল কমে আসায় নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে বলে জানিয়েছেন ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম।
সরেজমিন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, শুকনো খাবার ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগ আশ্রয়কেন্দ্রের পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই।
ফুলগাজী উপজেলার আলী আজম উচ্চবিদ্যালয় এবং পাশের মাদ্রাসা ভবনে শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা পরিবারগুলো এখন পর্যন্ত সহযোগিতা পায়নি। অনেকেই রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কোনো খাবার পায়নি। অনেকে স্কুল ভবনেই চুলা বানিয়ে রান্না করেছেন।
উপজেলার উত্তর শ্রীপুর গ্রামের বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে কোমরপানি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দোতলা ভবনের একটি কক্ষে গাদাগাদি করে প্রায় ৪০ জন মিলে থাকছি। বৃদ্ধ ও শিশুরা বেশি কষ্ট পাচ্ছে।’ 
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলামে বলেন, সব জায়গায় উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। কোথাও যদি ত্রাণ না পৌঁছায়, সেখানেও পাঠানো হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে ফুলগাজীর পানিবন্দি বিভিন্ন গ্রামে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে সেনাবাহিনীর কয়েকটি দল। সেনাবাহিনীর ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের দুরন্ত ১৫ সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের ১৩৯ সদস্যের একটি কোম্পানি উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজে নেমেছে। 
সেনাবাহিনীর কোম্পানির দায়িত্বে থাকা মেজর মোহাম্মদ রাশেদুল হাসান বলেন, আজ দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার কাজ শুরু করা হয়েছে। সেনাবাহিনী নিজস্ব ১০টি স্পিডবোটের মাধ্যমে দুর্গম এলাকায় পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ শুরু করেছে। এ ছাড়া কয়েকটি ছোট ডিঙি নৌকা দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, গত তিন দিনে সীমান্তবর্তী মুহুরী, কহুয়া, সিলোনিয়া নদীর বেড়িবাঁধের ফুলগাজী ও পরশুরাম অংশের ২০টি স্থান ভেঙে দুই উপজেলার ২৭ গ্রাম প্লাবিত হয়। এর মধ্যে পরশুরাম উপজেলায় বেড়িবাঁধের ১২টি অংশ ও ফুলগাজী উপজেলার আটটি অংশ ধসে পড়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলা থেকে পানি কিছুটা কমলেও নতুন করে ছাগলনাইয়া ও সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দুর্ঘটনা এড়াতে গতকাল রাত পর্যন্ত পরশুরাম ও ফুলগাজী উপজেলার ৩১ হাজার গ্রাহক বিদ্যুদ্বিচ্ছিন্ন ছিলেন। তবে আজ সকাল থেকে বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হচ্ছে।
নোয়াখালী : নোয়াখালীতে বৃষ্টির পরিমাণ কমেছে। ফলে জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে ড্রেনেজ অব্যবস্থাপনার কারণে পানি ধীরগতিতে নামছে। এ কারণে বৃষ্টি কমলেও শহরের বাসিন্দাদের দুর্ভোগ কমেনি। জেলা শহর মাইজদীসহ বিভিন্ন উপজেলার নিচু এলাকার বেশির ভাগ রাস্তাঘাট এখনো পানির নিচে। বৃহস্পতিবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, জেলা শহর মাইজদীর লক্ষ্মীনারায়ণপুর, সেন্ট্রাল রোড, জেলা জজ আদালত সড়ক, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকা, দরগাবাড়ী, সরকারি মহিলা কলেজ ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এলাকায় জলাবদ্ধতা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। তবে এখনো বেশির ভাগ সড়কে পানি আছে। এসব পানি মাড়িয়ে নিত্যদিনের কাজ করার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা বের হচ্ছে। বৃষ্টিপাত ও জলাবদ্ধতার কারণে সড়কের বিভিন্ন অংশ ভেঙেছে। এতে গাড়ি চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
জলাবদ্ধতার বিষয়ে জেলা পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক জালাল উদ্দীন বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করতে পৌরসভার পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা পানি চলাচলের পথগুলো সচল করে দিয়েছেন। দ্রুতই জলাবদ্ধতা পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে তিনি আশা করছেন।
কুমিল্লা : টানা ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গোমতী নদীর পানি প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে। ফলে নদীতীরবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গত বছরের বন্যার ক্ষতি এখনো পুষিয়ে উঠতে না পারা এসব মানুষ এখন আরেকটি বন্যার মুখোমুখি। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে তাদের।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় গোমতী নদীর পানি ৯ দশমিক ৬৮ মিটারে প্রবাহিত হতে দেখা গেছে। এই নদীর বিপৎসীমা ১১ দশমিক ৩ মিটার। 
আগের ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার-বুধবার) টানা ভারী বর্ষণ হয়। এরপর বুধবার সারা রাত থেমে থেমে বৃষ্টি পড়েছে। বৃহস্পতিবার ভোর থেকে আবার শুরু হয়ে সকাল ৮টা পর্যন্ত টানা বর্ষণ চলে। 
তবে বৃষ্টি থামলেও থেমে নেই ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢল। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারী বর্ষণ হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। সেখানকার পানি আসছে গোমতী নদীতে। ফলে নদীর কুমিল্লা অংশে পানি বাড়ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাত ১২টা পর্যন্ত গোমতী নদীর পানি ছিল বিপৎসীমার ৯ দশমিক ৪২ মিটারে। বুধবার সকাল ৮টায় পানি ছিল বিপৎসীমার ৮ মিটারে। বুধবার দিনব্যাপী নদীর পানি ১ দশমিক ৪২ মিটার বেড়েছে। বুধবার রাত ১২টা থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত নদীটির পানি বেড়েছে শূন্য দশমিক ২৬ মিটার। ৪৮ ঘণ্টায় গোমতী নদীর পানি বেড়েছে ৫ থেকে ৬ মিটারের মতো।
কুমিল্লা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী খান মো. ওয়ালিউজ্জামান বলেন, বুধবার রাতে ভারী বর্ষণ ছিল না। ভোরে আবার বর্ষণ ছিল। এখন আবার নেই। পানির প্রবাহ কিছুটা কম গতিতে বাড়ছে। তবে উজান থেকে নেমে আসা ঢল বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পঙ্কজ বড়ুয়া বলেন, গোমতীর পানি বাড়ার লক্ষণ দেখামাত্র আমরা ৫৮৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করেছি। পর্যাপ্ত শুকনো খাবার এবং সরকারি চাল মজুত আছে। সব উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।