অনেক দিন ধরে ২ লাখ টাকা চাঁদা চাচ্ছিল তারা। রাজি না হওয়ায় আমার স্বামীকে মেরেই ফেলেছে। এখন দুই সন্তান নিয়ে কোথায় যাব আমি? যারা আমার সন্তানদের এতিম করেছে, তাদের ফাঁসি চাই’Ñ বিলাপ করতে করতে কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর কেরানীগঞ্জে নিজ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সামনে গত বুধবার সন্ত্রাসীদের হাতে নৃশংসভাবে প্রাণ হারানো লালচাঁদ সোহাগের স্ত্রী লাকি বেগম।
গত শুক্রবার বরগুনার ঢলুয়া ইউনিয়নের রায়ভোগ গ্রামে মায়ের কবরের পাশে সোহাগকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে বরগুনা জেলায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। স্বজনরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়। এদিকে ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জেলার শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা ।
নিহত সোহাগের পরিবারের দাবি, পূর্বপরিকল্পিতভাবে সোহাগকে হত্যা করেছে স্থানীয় একটি চাঁদাবাজ চক্র। এই হত্যাকা-ের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বরগুনার বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা। গতকাল শনিবার সকাল ১১টায় বরগুনা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়।
পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, শৈশব থেকেই কঠিন জীবনযুদ্ধে নামেন সোহাগ। মাত্র সাত বছর বয়সে বজ্রপাতে বাবাকে হারান তিনি। এরপর মা ও দুই বোনের সঙ্গে ঠাঁই নেন নানাবাড়িতে। চরম দরিদ্রতার কারণে লেখাপড়া ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। ১২ বছর বয়সে হোটেলবয়ের কাজ শুরু করেন, কখনো বাসাবাড়িতে কাজ করেছেন, কখনো পান বিক্রি করেছেন মিটফোর্ড এলাকায়। বোনদের বিয়ে দেওয়ার পর ২০০৮ সালে বিয়ে করেন কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুরে। শুরু হয় সংসার। ২০১৪ সালে মায়ের মৃত্যুর পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেন সোহাগ। ভাঙ্গারির ব্যবসা করে অল্প সময়েই সফল হন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে নিজের ব্যবসা গড়ে তোলেন, হন সচ্ছল।
পরিবারের সদস্যরা জানান, সোহাগ রাজনীতি করতেন না, সমর্থন করতেন বিএনপিকে। ৫ আগস্টের পর কিছুটা সক্রিয় হয়ে যুবদলের নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। সেই ঘনিষ্ঠতাই কাল হয় তার জীবনে।
পরিবারের অভিযোগ, যুবদলের কিছু নেতাÑ মুমিন, টিটু, ফয়সাল সোহাগের ব্যবসায় শেয়ার বা মাসিক চাঁদা দাবি করে আসছিলেন। সোহাগ তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়।
গত ৯ জুলাই সকালে দোকানে গিয়ে তালা দেখতে পান সোহাগের এক সহযোগী। খবর পেয়ে সোহাগ বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে কেরানীগঞ্জের বাসা থেকে রওনা হন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে দোকানে তালা খোলার সময় জনসম্মুখে তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
সোহাগের ভাগ্নি বিথী ও মেয়ে সোহানা রূপালী বাংলাদেশকে জানান, হত্যার এক সপ্তাহ আগে একটি গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে এক অচেনা লোক সোহাগকে বিরক্ত করলে তিনি প্রতিবাদ করেন। এর পর থেকেই তিনি মানসিকভাবে অস্থির ছিলেন। মেয়ের কথায়, ‘বাবা বলতেন, তোমরা পড়াশোনা করো, বড় হও। কিন্তু তার মনে সব সময় ভয় কাজ করত।’
ঘটনার বিচার দাবিতে বরগুনা প্রেসক্লাব চত্বরে মানববন্ধন করেন সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ ও বিএনপি নেতারা। সান্ত¡না জানাতে আসা বরগুনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মো. নজরুল ইসলাম মোল্লা বলেন, ‘যারা এই নৃশংস হত্যাকা- ঘটিয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি-মৃত্যুদ--প্রয়োজন। আমরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই।’
পরিবারের দাবি, সোহাগের মৃত্যুর পর দায়ের হওয়া মামলায় মূল হোতাদের নাম বাদ দিয়ে মামলায় অন্যদের যুক্ত করা হয়েছে। ফলে তারা ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
ঢাবিসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে গত শুক্রবার রাত থেকে গতকাল শনিবার সারা দিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক দল ও নানা সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্যবসায়ী সোহাগকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলপাড়া থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হয়। এ সময় মিছিল থেকে বিভিন্ন স্লোগান দেওয়া হয়। মিছিলটি ভিসি চত্বরে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করে পুনরায় রাজু ভাস্কর্যের উদ্দেশে রওনা হয়।
এ ছাড়া গতকাল শনিবার দুপুরে রাজধানীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে বিক্ষোভে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী সমাজ’-এর ব্যানারে এই বিক্ষোভ হয়। দুপুর ১২টার দিকে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) শিক্ষার্থীরাও বিক্ষোভ করেন।
এ ছাড়া ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকা-ের প্রতিবাদে এবং দেশব্যাপী ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও সহিংসতার বিচার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (গোবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিভিন্ন অনুষদের শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন।
সোহাগকে নির্মমভাবে হত্যা এবং দেশব্যাপী চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যকর কর্মকা-ের প্রতিবাদে গত শুক্রবার রাতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এ দিন শত শত শিক্ষার্থী রাত ১০টায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরাণ হল থেকে মিছিল শুরু হয়ে বঙ্গবন্ধু হলে গিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়।
ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল গেটের সামনে নৃশংসভাবে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীকে হত্যার প্রতিবাদে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। গতকাল দুপুরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটকের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ শেষে ক্যাম্পাসে মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা।
এ ছাড়া রাজবাড়ী, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, মুন্সীগঞ্জ, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, লালমনিরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় সোহাগ হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
আপনার মতামত লিখুন :